১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু অনিক টেলিকমের। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অ্যাক্সেসরি উৎপাদন করা সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে তাদের দুটো পণ্য সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে, মোবাইল ফোন চার্জার এবং ব্যাটারি। ২০১০ সালে কোম্পানিটির শীর্ষ সময়ে তারা প্রতি মাসে ৫ লক্ষ মোবাইল ফোন চার্জার বিক্রি করতো, সাথে ব্যাটারিও ছিল ভালো পরিমাণে। কিন্তু তাদের ব্যবসা প্রথমে হোঁচট খায় এবং শেষমেশ ভেঙে পড়ে মূলত রিটেইলার ও ক্রেতাদের শোষণমূলক মনোভাবের কারণে
অনিক টেলিকমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মশিউল আজম/ ছবি: নূর-এ-আলম/ টিবিএস: ১৯৯৬ সালে ৩৬ বছর বয়সী মশিউল আজম কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে রাজধানীর মগবাজার প্লাজা মার্কেটের তিন তলায় একটি ফোন ফ্যাক্সের দোকান খোলেন। দোকানের নাম দেওয়া হয় অনিক টেলিকম।
বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর সিটিসেলসহ আরও বেশ কিছু কোম্পানির জন্য টেলিকমিউনিকেশন সম্পর্কিত সার্ভিসিং সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যবসা শুরু করে তারা।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই অনিক টেলিকম হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন অ্যাক্সেসরি উৎপাদন করা সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে তাদের দুটো পণ্য সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে, মোবাইল ফোন চার্জার এবং ব্যাটারি।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অনিক টেলিকমের পণ্যগুলো সারাদেশের মোবাইল ফোন জগতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। পণ্যগুলোর চমৎকার গুণমান এবং এর ছয় মাসের গ্যারান্টি কার্ডের (যদি ছয় মাসের মধ্যে পণ্যটি নষ্ট হয়ে যায়, তবে সম্পূর্ণ নতুন পণ্য দিতে বাধ্য থাকবে অনিক টেলিকম) জন্য কোম্পানিটির ব্যবসা হু হু করে বাড়তে থাকে।
২০১০ সালে কোম্পানিটির শীর্ষ সময়ে তারা প্রতি মাসে ৫ লক্ষ মোবাইল ফোন চার্জার বিক্রি করতো, সাথে ব্যাটারিও ছিল ভালো পরিমাণে। মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করতো তারা।
৬৩ বছর বয়সী অনিক টেলিকমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মশিউল আজম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, “পুরো দেশের ৮০ শতাংশ মোবাইল ফোন চার্জার এবং ব্যাটারি আমরা সরবরাহ করতাম। অর্থাৎ, বাজারে যদি ১০০টি চার্জার বিক্রি হতো, তার ৮০টিই হতো আমাদের। বিক্রি এতটাই বেশি ছিল যে, এই পরিমাণ চার্জার সরবরাহ করতে আমাদেরই কষ্ট হয়ে যেত।”
তবে ব্যবসা হঠাৎ করে উল্টোদিকে মোড় নেয়।
মশিউল আজমের ব্যবসা প্রথমে হোঁচট খায় এবং শেষমেশ ভেঙে পড়ে মূলত রিটেইলার ও ক্রেতাদের শোষণমূলক মনোভাব এবং মশিউল আজমের ব্যবসায়িক কৌশলের অপব্যবহার করে: যেটি হলো ছয় মাসের রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি কার্ড।
তবে এর সাথে মশিউলের উদারমনা স্বভাবও হয়তো কিছুটা দায়ী। আক্ষেপ করে মশিউল বলেন, “তারিখবিহীন রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি কার্ড এভাবে দেওয়াটা উচিৎ হয়নি। আমার মতে কারোই এই কাজ করা উচিত না।”
বর্তমানে কোম্পানিটি বাল্ব হোল্ডার, সুইচ এবং অন্যান্য ইলেকট্রিক ল্যাম্পের মতো কিছু ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদন করে, তবে কম পরিমাণে। অনিক টেলিকম তাদের নতুন পণ্যগুলোতে এখন আর রিপ্লেসমেন্ট কার্ড দেয় না।
কীভাবে মগবাজার প্লাজা মার্কেট থেকে পুরো দেশে অনিক টেলিকম ছড়িয়ে পড়লো, কীভাবে তারা তাদের সেরা সময়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে শেষমেশ সবকিছু হারালো, সে কাহিনীর আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া যাক।
ব্যবসার সূচনা: ১৯৯৬ সালে অনিক টেলিকম তাদের প্রথম ক্লায়েন্ট সিটিসেলের সাথে ওতপ্রোতভাবে কাজ করতে থাকে। যেমন, সিটিসেলের নতুন ক্রেতাদের জন্য তারা অ্যান্টেনা ইন্সটল করে সিটিসেলের সেবার সাথে সংযোগ করে দিত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও তারা পিএবিএক্স স্টেশন ইন্সটল করাসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল সেবা দিত।
একইসাথে মশিউল সিটিসেলের আরেকটি পণ্য টেলুলারের হয়েও কাজ করতেন। টেলুলার হচ্ছে একজায়গায় স্থির থাকা ফোন যেটিতে ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়ার জন্য একটি অ্যান্টেনার প্রয়োজন হতো। বাংলাদেশের প্রান্তিক বিভিন্ন জায়গার লোকজনই মূলত ফোন ফ্যাক্স সার্ভিসের ব্যবসার জন্য সিটিসেলের সংযোগ নিতো।
তখনকার সময়ে অনিক টেলিকম অ্যান্টেনাগুলো সিঙ্গাপুর এবং চীন থেকে আমদানি করতো। তবে ১৯৯৭ সালের দিকে তারা নিজেরাই অ্যান্টেনা উৎপাদন করা শুরু করে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মোবাইল ফোন অ্যাক্সেসরি তৈরি শুরু করে তারা।
ক্রমেই এই অ্যান্টেনার চাহিদা বাড়তে থাকে।
“তখনকার সময়ে কানেকশনসহ একটি সিটিসেল মোবাইল ফোনের দাম ছিল এক লাখ টাকারও বেশি,” জানান মশিউল।
মগবাজারের টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে বেড়ে উঠেছেন মশিউল। সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন।
তার বাবা হাতেম আলী টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বিভাগে (টিঅ্যান্ডটি) সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।
প্রায়ই মশিউল আজম মহাখালীতে সিটিসেলের মেইন অফিসে যেতেন, যেখানে তিনি সিটিসেলের সেলস সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সিটিসেলের ভোক্তারা প্রায়ই সিটিসেলকে অতিরিক্ত ব্যাটারি এবং চার্জারের চাহিদা জানাতো। এর ফলে সিটিসেলের একজন কর্মকর্তা মশিউল আজমকে ফোনের ব্যাটারি এবং চার্জার আমদানি করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।
১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোন নতুন মোবাইল ফোন অপারেটর হিসেবে বাজারে ঢোকার পর মোবাইল ফোন অ্যাক্সেসরিজের চাহিদা আরও বেড়ে যায়।
অনিক টেলিকমের পরবর্তী ব্যবসায়িক পদক্ষেপ: মশিউল আজম জানান, “১৯৯৮ সালে আমরা চীন থেকে মোবাইল চার্জার, ব্যাটারিসহ অন্যান্য অ্যাক্সেসরি আমদানি শুরু করি।”
প্রথমদিকে মাসে ২০০ থেকে ৫০০টি চার্জারের চাহিদা ছিল। তখন প্রতিটি চার্জার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হতো, সেগুলো তিনি কিনতেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। যখন মশিউল দেখলেন দিনদিন চার্জার-ব্যাটারির চাহিদা বেড়েই চলেছে, তখন তিনি ভাবলেন চার্জারের পার্টগুলো আমদানি করে এগুলো দেশেই উৎপাদন করা গেলে কেমন হয়?
“এখনকার মোবাইল ফোনগুলোকে তিন ধরনের চার্জার দিয়েই চার্জ করা যায়, এরমধ্যে আছে সি-টাইপ ও মিনি ইউএসবি। তখনকার সময়ে অবস্থা এমন ছিল না। সিমেন্সের চার্জিং পোর্ট ফিলিপস আর এরিকসনের চেয়ে ভিন্ন ছিল। আবার নোকিয়ার বিভিন্ন মডেলের বিভিন্ন ধরনের পোর্ট ছিল। অনেক ধরনের ফোন ছিল সেসময়,” বলেন মশিউল।
“১০০টি ফিলিপসের চার্জার কিনে দেখি আমি মাত্র ২০টি চার্জার বিক্রি করতে পেরেছি। ততদিনে এই মডেল বাজার থেকে চলেও গিয়েছে। আমাদেরকে লাভ ওঠানোর জন্য এই মডেলের চার্জারগুলোকে একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়েছিল,” ২০০০-এর দশকের বাজারের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডিলার আর রিটেইলাররা মগবাজারে অনিক টেলকমের দোকানে আসা শুরু করে ব্যাটারি এবং চার্জার কেনার জন্য। তারা ইতোমধ্যেই অ্যান্টেনার কারণে অনিক টেলিকম নামের সাথে পরিচিত ছিল।
“আমরা আমাদের বিজ্ঞাপনে লিখেছিলাম, যদি আপনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তবে আমাদের এই বিজ্ঞাপনটি সাথে রাখুন, এটি পরে আপনার কাজে লাগতে পারে,” বলেন মশিউল।
ব্যবসার পরিস্থিতি বেশ ভালো থাকায় এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ব্যবসা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন মশিউল। মোবাইল ফোন চার্জার অ্যাসেম্বল করার কাজ বাংলাদেশেই করার সিদ্ধান্ত নেন।
ট্রান্সফর্মার, আইসি, রেক্টিফায়ার, ক্যাপাসিটর, রেজিস্ট্যান্স, পিসিবি বোর্ডসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানি শুরু করেন তারা এবং সেগুলো জোড়া দিয়ে মোবাইল ফোন চার্জার বানানোর জন্য মগবাজারের দোকানের পাশে একটি বাসা ভাড়া নেন তারা।
“চার্জারের কেসিং বানানোর জন্য আমরা চীন থেকে লোহার ঢালাই নিয়ে আসি, তখনকার সময়ে ব্যাপক চাহিদা ছিল এর। চীন থেকে আনা মোল্ড দিয়ে রাজধানীর শনির আখড়ার একটি জায়গা থেকে মেশিন ভাড়া নিয়ে কেসিং তৈরি করা শুরু করি।”
সে সময় নোকিয়া ফোনগুলোর চার্জারের চাহিদা ব্যাপক পরিমাণে ছিল, বিশেষ করে নোকিয়া ৩৩১০, নোকিয়া ৫১১০ এবং নোকিয়া ১৬১০ মডেলের ফোন চার্জারগুলো। এর সাথে সিমেন্সের এস৬ এবং এস৪ মডেলের চাহিদাও ছিল প্রচুর।
একটি ভুল কৌশল: অনিক টেলিকমের চার্জারের তারিখবিহীন রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি কার্ডকে ডিলার আর রিটেইলাররা অপব্যবহার করেছে বলে আক্ষেপ করেন মশিউল আজম।
ছয় মাসের মেয়াদ আছে কিনা তা দেখার জন্য ডিলার এবং রিটেইলারদেরকেই বিশ্বাস করেছিলেন মশিউল। তিনি ভেবেছিলেন রিটেইলার এবং ডিলাররা ক্রেতাদের চার্জার কেনার সময়েই সেই তারিখটি কার্ডে লিখে রাখবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রায়ই তারা কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করা চার্জারের ওয়ারেন্টি কার্ডে নকল তারিখ লিখে সেটি পাল্টে নিতেন।
এর মানে হচ্ছে, যদি কেউ অনিক টেলিকম থেকে কখনো একটি চার্জারও কিনে থাকে, সে ওই তারিখবিহীন ওয়ারেন্টি কার্ডে যেকোনো তারিখ বসিয়ে আজীবন ধরে নতুন চার্জার ব্যবহার করতে পারবে।
মশিউল বলেন, “এটা অনেকটা বুমেরাংয়ের মতো কাজ করেছিল। গ্যারান্টি কার্ডের সুবিধাকে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছিল বেশ কয়েকজন রিটেইলার এবং ডিলাররা। এমনকি অনেক ক্রেতাই পাঁচ মাস ব্যবহার করার পর ইচ্ছা করে চার্জারটিকে নষ্ট করে নতুন চার্জার নিয়ে যেত।”
যখন মশিউল নতুন পণ্য ফেরত দিতে ব্যর্থ হতো, তখন তাকে পণ্যের দামটি ফেরত দিতে হতো। মশিউল আজম বলেন, “বাংলাদেশে আমার এই সুযোগ দেওয়া উচিৎ হয়নি। এই রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টির কারণেই আমাকে চার্জার আর ব্যাটারির ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।”
তার মতে, অনেক দোকানদারই তাদের কাছ থেকে ফ্রি রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে গিয়ে ক্রেতাদের কাছে ১০ থেকে ২০ টাকা রিপ্লেসমেন্ট ফি হিসেবে কেটে রাখতো।
২০১০ সালে অনিক টেলিকমের ব্যবসার শীর্ষ সময়ে সারা দেশজুড়ে ১০০ জন ডিলার ছিল। এবং তাদের অনেকেই নিজেদের দোকান খুলে অনিকের মতো চার্জার বানাতে থাকে। মশিউল জানান, যেখানে অনিক টেলিকমের চার্জার ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে, সেখানে তাদের চার্জারের দাম ছিল ৪০ টাকা।
এমনকি মশিউলের অধীনে কাজ করা অনেকেই চাকরি ছেড়ে নিজেরাই চার্জারের ব্যবসা খুলে বসে।
“কারণ তারা ইতোমধ্যেই ব্যবসার আগাগোড়া জেনে গিয়েছে,” বলেন মশিউল। সাথে যোগ করেন, এখনো অনেকেই তাদের পণ্যের সাথে অনি টেলিকমের নাম যোগ করে দেন তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং চাহিদার কারণে।
অনিক টেলিকমের ব্যাটারিরও প্রায় একই পরিণতি হয়: ২০০৯ সালে অনিক টেলিকম এক মাসে রেকর্ড ৭ লক্ষ ব্যাটারি বিক্রি করে। গড়ে তারা মাসে এক থেকে দেড় লক্ষ ব্যাটারি বিক্রি করতো। অনেক মোবাইল ফোন কোম্পানিই কম দামে মোবাইল ফোন বিক্রি শুরু করে (৯০০ টাকাতেও মোবাইল বিক্রি শুরু হয়)। এগুলোতে যে ব্যাটারি ছিল, সেগুলো খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে, ব্যাটারির চাহিদাও ব্যাপকহারে বেড়ে যায়।
তখন অনিক টেলিকম নোকিয়া ৩৩১০ ফোনটির জন্য ২,২০০ অ্যাম্পিয়ারের একটি ব্যাটারি বিক্রি করতো, যেটি এক চার্জেই তিন থেকে চারদিন চলতো। ব্যাটারিটির দাম ছিল ২২০ টাকা। মশিউল জানান, “ব্যাটারিতে আমি যে লেবেল ব্যবহার করতাম, সেটার দামই পড়তো ৩.৫ টাকা।”
গুলিস্তান মার্কেটে মানভেদে ৩৫, ৪০ বা ৭০ টাকায় ব্যাটারি বিক্রি হতো। মশিউল আলম জানান, “ব্যাটারির সমস্যা হলো, আপনি কখনোই দেখে বুঝতে পারবেন না এটি কতদিন চলবে।”
ফলে ব্যাটারি জালিয়াতি করার সুযোগ ছিল অবারিত। অনেক ব্যবসায়ী খারাপ মানের চীনা ব্যাটারি আমদানি করে তাতে অনিক টেলিকমের লেবেল সেঁটে দিতেন।
“একদিন এক ব্যাংক ম্যানেজার আমাকে জানান যে আমার ব্যাটারির মান অনেক কমে গিয়েছে। একদিনের বেশি চার্জ ধরে রাখতে পারে না । আমি ফোনটি খুলে নিজে ব্যাটারিটি পরীক্ষা করে দেখি। আমি দেখি আমার কোম্পানির লেবেল থাকলেও সেটি আমার কোম্পানির পণ্য নয়। আপনি কখনোই বুঝতে পারবেন না যে এটি অনিকের নাকি অন্য কোম্পানির। আমরা এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়ে যাই।”
একপর্যায়ে বাজারে ২২০ ধরন ও আকারের ব্যাটারি পাওয়া যেত। ব্যবসায়ীরা বিশাল পরিমাণে ব্যাটারি আমদানি করতো, যেগুলো ১০ থেকে ১৫ টাকাতেও বিক্রি হতো। এগুলো টর্চ লাইট কিংবা খেলনায় ব্যবহৃত হতো।
২০১২ সালের শেষে অনিক টেলিকম এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যখন প্যাকেট ধরে চার্জার এবং ব্যাটারি তাদের কাছে ফেরত আসতে থাকে, যেভাবে সেগুলো বিক্রি করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে।
মশিউল বলেন, “উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, এক মাসে আমরা ৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করি। এবং তারপর সেই ৫ লাখ টাকা দামের পণ্যই আমাদেরকে রিপ্লেস করতে হয়। আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাই যে আমরা নিজেদের পণ্যই ঠিকঠাকভাবে চিনতে পারছিলাম না। কিছু কিছু লোকজন চীনে গিয়ে আমাদের কোম্পানির হলোগ্রাম বানিয়ে নিয়ে আসে এবং আমাদের হলোগ্রাম বসিয়ে কম দামী বাজে মানের ব্যাটারি বিক্রি করতে থাকে।”
কৌশল পরিবর্তন: ২০১১ সালে মশিউল আজম তার ডিলার আর রিটেইলারদেরকে জানান, তিনি রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি আর দেবেন না, তবে এর বদলে তাদেরকে ১০ শতাংশ পণ্য কেনার আগেই অ্যাডভান্স হিসেবে দেবেন। প্রথমদিকে তারা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও যখন বুঝতে পারে যে এর চেয়ে রিপ্লেসমেন্ট সুবিধায় বেশি লাভ, তখন তারা ১৫% পণ্য অ্যাডভান্স হিসেবে চায়।
“আমি তাদেরকে ১৫% পণ্য অ্যাডভান্স হিসেবে দেই এবং জানাই তারা যেন আমার কাছে রিপ্লেসমেন্টের জন্য আর না আসে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ডিলার আর রিটেইলাররা আমার কাছ থেকে পণ্য কেনা বাদ দিয়ে দেয়।”
অনেক দোকানদারই তাদের ক্রেতাদেরকে জানায় যে, অনিক টেলিকম আর রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা দিচ্ছে না এবং তার বদলে তাদেরকে অন্য কোম্পানির পণ্য কিনতে উদ্বুদ্ধ করেন।
“আমরা যখন এই বিষয়ে কঠোর হতে শুরু করি, তখন তারা আমাদেরকে জানায় যে তারা আর আমাদের পণ্য কিনবে না। শেষমেশ আমি ২০১৮ সালে পুরোদমে এই রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি বাদ দিতে বাধ্য হই,” বলেন মশিউল।
ডিলার আর রিটেইলাররা তারিখবিহীন কার্ডে নকল তারিখ লিখে (ছয় মাসের মধ্যে থাকা তারিখ) চার্জার এবং ব্যাটারি পাঠাতে থাকেন হাজারে হাজারে। এটি থামাতে অনিক টেলিকমের তিন বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। “কোনো বিক্রি নেই, তারপরেও চার্জার আর ব্যাটারি আসতেই রয়েছে। এটি আমার ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে,” বলে জানান তিনি।
২০১৮ সালে মশিউল আজম এমন পণ্যের ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেন যেটিতে কোনো রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হবে না এবং সে অনুযায়ী, সুইচ, হোল্ডার, ল্যাম্পসহ অন্যান্য ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেন তিনি। এবং নিশ্চিতভাবেই এর সাথে কোনো গ্যারান্টি কার্ড ছিল না।
তবে অনিক টেলিকম এখনো মোবাইল চার্জার বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে দারাজের মতো অনলাইন মার্কেটগুলোতে, তবে খুব কম পরিমাণে। এখনো তারা গ্যারান্টি কার্ড দেয়, তবে এবার তারা বিক্রির সময় নিজেরাই গ্যারান্টি কার্ডের তারিখ লিখে দেয়।