জনতার কণ্ঠ নিজস্ব প্রতিবেদক: অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার পর ক্যাম্পাস ছাড়ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে নগরের চকবাজার এলাকায় কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনায় পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল শনিবার রাতে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন রক্তিম দে (২১) ও এনামুল হোসেন ওরফে সীমান্ত (২১)। দুজনই চমেক এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। রক্তিম দে ১১ ও এনামুল হোসেন এজাহারভুক্ত ১৫ নম্বর আসামি।
গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে মাহাদি জে আকিব নামের এক ছাত্রকে মারধরের ঘটনায় এ মামলা হয়। আকিব বর্তমানে চমেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেন আকিবের ভাই তৌফিকুর রহমান।
পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান বলেন, আকিবকে মারধরের ঘটনায় এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা মেডিকেলের ছাত্র।
এদিকে ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আকিবকে মারধরের ঘটনার প্রতিবাদে আজ রোববার বেলা ১১টায় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে ছাত্রলীগের এক পক্ষ।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার রাতে ও গতকাল শনিবার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের মধ্যে এই মারামারি হয়। এই দুই নেতার অনুসারীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুই পক্ষের সংঘর্ষে তিনজন আহত হন। তাঁরা হলেন মাহফুজুল হক, নাইমুল ইসলাম ও মাহাদি জে আকিব। তাঁরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাহাদি জে আকিব মহিবুল হাসানের অনুসারী, আর অপর দুজন নাছিরপন্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। আহত তিনজনই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, মাহাদির মাথা ফেটে গেছে। তাঁর জরুরি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহফুজুল কাদের বলেন, ‘মাহাদি জে আকিবের অস্ত্রোপচার হয়েছে। মাথার হাড় ও ব্রেনে ইনজুরি আছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
কলেজ সূত্র জানায়, করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ১৩ সেপ্টেম্বর কলেজে সশরীর শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুর দুই দিনের মাথায় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে সে সময় কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে। রাতে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহফুজুল হক ডাইনিংয়ে খেয়ে নিজের কক্ষে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষের কয়েকজন কটু মন্তব্য করেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছাত্রলীগের কর্মী মাহফুজুল হক ও নাইমুল ইসলামকে মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী পক্ষ মারধর করে। এর জের ধরে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাতে মহিবুল হাসানের অনুসারীদের দুটি ও প্রতিপক্ষের অনুসারীদের একটি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকে বুঝিয়ে শান্ত করে। এরপর কলেজের অধ্যক্ষ গতকাল দুই পক্ষের পাঁচজন করে প্রতিনিধিকে নিয়ে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলাকালে সকাল ১০টার দিকে মহিবুল হাসানের অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী মাহাদি জে আকিবকে ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় ধরে মারধর করে প্রতিপক্ষ। এরপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দুই পক্ষ ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারীরা অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে অবস্থান নেন। অধ্যক্ষ এ সময় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ এসে তাঁদের সরিয়ে দেয়।
জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক সাদেকুর রহমান (তদন্ত) প্রথম আলোকে বলেন, রাতে ছাত্রাবাসে সমস্যা হয়। ওই ঘটনার জের ধরে গতকাল কলেজের সামনে ফুটপাতে অন্য পক্ষের একজনকে মারধর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
কলেজ বন্ধ ঘোষণা: ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেলা দেড়টার দিকে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কলেজের অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবারের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে অধ্যাপক মতিউর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।
কলেজের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের চলমান সব পেশাগত পরীক্ষা আপাতত স্থগিত করা হলো। কলেজ না খোলা পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা অযথা কলেজ ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারবেন না। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস পুলিশ প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করা হলো। পুলিশ প্রয়োজনবোধে যেকোনো শিক্ষার্থীর কক্ষ তল্লাশি করতে পারবে।’
আকস্মিক বন্ধ ঘোষণায় বিপাকে পড়েন দূরের শিক্ষার্থীরা। তারপরও নির্দেশমতো ছাত্রছাত্রীদের ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে দেখা যায়। ৫৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী কে এম তানভীর যাবেন ঢাকায়। তিনি বলেন, সন্ধ্যার মধ্যে হল ছাড়তে হচ্ছে। হঠাৎ করে ট্রেন বা গাড়ির টিকিট জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর মতো একই অবস্থা দূরের শিক্ষার্থীদের।
থানায় মামলা: মারামারির ঘটনায় মহিবুল হাসানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত তৌফিকুর রহমান নামের এক ছাত্র পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে বলা হয়, শুক্রবার রাতে ছাত্রাবাসে আকিবের সঙ্গে সাদ মো. গালিবসহ কয়েকজনের কথা-কাটাকাটি হয়। এই ঘটনার জের ধরে শনিবার ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের পাশে আকিবকে তাঁরা রড, লাঠি ও ছোরা দিয়ে আঘাত করেন।
বারবার: সংঘর্ষ ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, এর আগে চলতি বছরের ২ মার্চ কলেজের ছাত্রাবাসে দুই পক্ষের মারামারি হয়। তখন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের ১৩ আগস্ট ছাত্রাবাসে এই দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। তার পরদিন কলেজ কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এ বছরের ২ মার্চের মারামারির পরদিন আবার সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার বলেন, ‘আমরা সভা-সমাবেশ বন্ধ করেছিলাম, যাতে ক্যাম্পাস শান্ত থাকে। এরপর সভা-সমাবেশ হয়নি। হোস্টেলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়।’
দুই পক্ষের কারণে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরোধে উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও। গত দুই মাসে ক্যাম্পাসে দুই পক্ষের মধ্যে পাঁচবার সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ ১৪ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপপক্ষ চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার ও সিক্সটি নাইন।
সিক্সটি নাইন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির ও চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ারের নেতা-কর্মীরা মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, আধিপত্য বিস্তার, হলের কক্ষ দখল ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন এই দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। আর শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অসুস্থ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, নেতাদের দলাদলির প্রভাব যদি ছাত্রদের মধ্যে পড়ে, তাহলে শিক্ষার জন্য তা ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন কোভিডের কারণে বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এখন আবার ছাত্রসংগঠনের মারামারিতে কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। এটা কাম্য নয়। নেতাদের উচিত তাঁদের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ করা।