আগামী দিনে একটা অংশগ্রহণমূলক সংসদ হোক-আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
প্রশ্ন: আপনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। একই সঙ্গে আপনি বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির অন্যতম প্রধান। বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নাকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়—কোনটি আপনার পছন্দের তালিকায় ওপরে থাকবে?

আমীর খসরু: এটা তো আমার দলের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত। আমাকে যদি দল কোনো দায়িত্ব দিতে চায়, আমি সব দায়িত্বই পালন করতে রাজি। আমরা যখন রাজনীতি করি, আমাদের সবকিছু কমবেশি জানতে হয় বুঝতে হয়। আপনাকে যে দায়িত্ব দেয়, সে দায়িত্বে পারফর্ম করার জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে হবে।

আমীর খসরু: বিএনপি কিন্তু তার রাজনৈতিক গাইডলাইন দিয়েছে ৩১ দফায় (রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার প্রস্তাব)। শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে যে পরিবর্তন হয়েছে, যারা সেটা বুঝবে না, ধারণ করবে না, তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সেটা রাজনীতিবিদ হোক, আর যে–ই হোক। এটা এক নম্বর। দুই নম্বর হচ্ছে, বিগত দিন থেকে যদি আপনি বেরিয়ে আসতে চান, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। অন্য যারা রাজনৈতিক দল, তারা আপনার শত্রু হতে পারে, তবু তাদের প্রতি সহনশীল হতে হবে। তাদের সঙ্গে আপনার ভিন্নমত হবে, ভিন্নমত পোষণ করেও আগে তাদের মতকে রেসপেক্ট (সম্মান) করতে হবে। এবং তার সেই ভিন্নমতের অধিকার আপনাকে সমুন্নত রাখতে হবে।

না, আমরা প্রতিশোধের রাজনীতি করব না। তাহলে তো বাংলাদেশ আগের জায়গায় চলে যাবে। তাহলে তো শেখ হাসিনাকে বিদায় করার দরকার ছিল না।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রশ্ন: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কি ভিন্নমতকে সমুন্নত রাখার কাজ করছে?

আমীর খসরু: এটা আমি বলতে পারব না, সরকার বলতে পারবে আর সাংবাদিকেরা বলতে পারবে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তারেক রহমান সাহেবের বক্তব্যে এ কথাগুলো আছে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আজ যারা সংস্কারের কথা বলছে, তাদের মাঠেও দেখি নাই, তাদের মুখ দিয়ে সংস্কারের কথাও শুনিনি। সুতরাং এটাকে যদি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চায়, তাদের মুখে কালি পড়বে।

প্রশ্ন: বিএনপি তো এত দিন অনেক নির্যাতন সহ্য করেছে, তাই রাজনৈতিক প্রতিশোধের কথাটা সামনে এসেছে।

আমীর খসরু: না, আমরা প্রতিশোধের রাজনীতি করব না, প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না। তাহলে তো বাংলাদেশ আগের জায়গায় চলে যাবে। তাহলে তো শেখ হাসিনাকে বিদায় করার দরকার ছিল না। আমি স্পষ্টতই বলছি, প্রতিহিংসার রাজনীতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই এগোনো সম্ভব হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
প্রশ্ন: বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টানোর কথা বলছে। অথচ বিএনপি সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে—এমন কথাই অনেকের মুখে মুখে, কেন?

আমীর খসরু: সংস্কার তো এনেছে সবার আগে বিএনপি। বিএনপির জন্মই হয়েছে সংস্কারের মাধ্যমে। একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সরকার চালিত অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণ, এ ধরনের সব রাজনৈতিক ভালো ভালো সংস্কার তো বিএনপিই করেছে। বাংলাদেশের যতগুলো অর্থনৈতিক সংস্কার, অল মোস্ট সবগুলোই বিএনপির করা। আজ বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিকভাবে, এর ভিত তো তৈরি করেছে বিএনপি।

প্রশ্ন: তাহলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘সংস্কার’ নিয়ে কথাগুলো কেন আসছে?

আমীর খসরু: গণতন্ত্র আর সংস্কারকে মুখোমুখি করতে যারা চায়, এটা তাদের কথা। আজ থেকে আট বছর আগে ‘ভিশন-২০৩০’ দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার পলায়নের পরে কী হবে, আমরা সেটা মাথায় রেখে দুই বছর আগে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা প্রথমে ২৭ দফা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি, পরে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মতামত নিয়ে সেটা ৩১ দফা হয়েছে। এখন সেই ৩১ দফা নিয়ে আমরা প্রতিদিন জেলায় জেলায় যাচ্ছি। আজ যারা সংস্কারের কথা বলছে, তাদের মাঠেও দেখিনি, তাদের মুখ দিয়ে সংস্কারের কথাও শুনিনি। সুতরাং এটাকে যদি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কেউ ব্যবহার করতে চায়, তাদের মুখে কালি পড়বে। কারণ বিএনপি হচ্ছে সংস্কারের দল।

প্রশ্ন: এই যদি বিএনপির অবস্থান হয়, তাহলে জামায়াত বা জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) সঙ্গে সংস্কার নিয়ে বিএনপির বিরোধটা কেন?

আমীর খসরু: যখন আপনার হাতে কিছুই থাকবে না, তখন আপনাকে কিছু আবিষ্কার করতে হবে। যে জিনিস আপনি আবিষ্কার করতে চাইছেন, সে জিনিসের সমাধান যে বিএনপি বহু আগেই দিয়ে দিয়েছে, এটা যারা বোঝে না, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে।

প্রশ্ন: সম্প্রতি লন্ডনে জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ দুজন নেতা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে।

আমীর খসরু: কোনো আলোচনার বিষয় নেই এখানে। ওনারা দেখা করতে চেয়েছেন। এটা হচ্ছে সৌজন্য সাক্ষাৎ। এর বাইরে আমার অন্তত কিছু জানা নেই এ ব্যাপারে। এই কালচারটা (দেখা-সাক্ষাৎ) কিন্তু আমাদের নষ্ট করে দেওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন : আলোচনার বিষয়ে জানতে রাজনৈতিক মহলে বেশ কৌতূহল জেগেছে। কারণ, বিএনপি ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড়। জামায়াত আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন চেয়ে আসছে। কিন্তু জামায়াতের আমির লন্ডনে থেকে ফেরার পর পরই বলেছেন, সংস্কার সেরে আগামী রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে। অনেকে বলছেন, এই পরিবর্তনটা এসেছে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর।

আমীর খসরু: আমি তো স্পেকুলেট (অনুমান) করতে পারব না কী আলোচনা হয়েছে। আমি তো বলেছি, আলোচনা হতে অসুবিধা নেই এবং আলোচনার ফল যদি কোথাও হয়ে থাকে সেটারও অসুবিধা কী। আলোচনা করে যদি কোনো কিছুর সমাধান হয়, এটাই বা খারাপ কী। এ জন্যই আলোচনাটা দরকার। গণতন্ত্রের একটি বড় স্তম্ভ হচ্ছে ডায়ালগ (সংলাপ), এটা তো শুধু মুখে মুখে বললে হবে না।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি করলে বাংলাদেশ আগের জায়গায় চলে যাবে
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি করলে বাংলাদেশ আগের জায়গায় চলে যাবে
প্রশ্ন: এখন দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন আশা করেন?

আমীর খসরু: আমরা তো ডিসেম্বরের আগেই আশা করতে পারি। কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তো সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। সব রাজনৈতিক দল তাদের প্রস্তাবগুলো জমা দিয়েছি অলরেডি (ইতিমধ্যে)। আমরা আমাদের সংস্কারের প্রস্তাব জমা দিয়েছি, অন্যান্য দলও দিয়েছে। এখন শুধু কোথায় কোথায় ঐকমত্য হয়েছে, সবাই তো এ ব্যাপারে ঐকমত্য যে ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার হবে। সুতরাং যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, এই জিনিসগুলো বলা হচ্ছে না কেন। এটা তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার না, এতে এক সপ্তাহও লাগার কথা না। কোথায় ঐকমত্য হচ্ছে, এই জিনিসটা বের করার জন্য তো নতুন কিছু আবিষ্কার করার দরকার নেই। শুধু একটা টেবিল (ছক) করা যে এ জায়গায় ঐকমত্য হয়েছে। যেগুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সে বিষয়গুলোকে সামনে এনে ‘জাতীয় সনদ’ যেটা বলছে, সেটাতে সই করে দিলাম। সুতরাং নির্বাচন ঘোষণা তো আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে করা সম্ভব এবং ডিসেম্বরের অনেক আগে করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন বলছে তারা প্রস্তুত, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমরা তো কোথাও সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না।

প্রশ্ন: ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে বিএনপি কত আসন পেতে পারে?

আমীর খসরু: এটা জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমরা কেউ না।

সব দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুপক্ষীয়। ভারত একটি দেশ এবং ভারতের গুরুত্ব, তারা আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং এ সবকিছু মাথায় রেখেই আমাদের আগামী দিনের বিদেশনীতি।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রশ্ন: রাজনীতিবিদেরা তো দূরদর্শী, আগামী সংসদটা কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

আমীর খসরু: আমরা তো চাই ভালো সংসদ হোক। আমরা চাই একটা অংশগ্রহণমূলক সংসদ হোক। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল হোক এবং তারা জনগণের কথা বলুক। আমরা একটা ভালো বিতর্ক দেখতে চাই সংসদে। বাংলাদেশের মানুষ পার্লামেন্টে বিতর্কের কথা ভুলেই গেছে।

প্রশ্ন:     আওয়ামী লীগ না থাকলে সেটি কীভাবে সম্ভব?

আমীর খসরু: আমি কোনো দলের কথা এখানে বলব না। কোন দল থাকবে, কোন দল থাকবে না, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। এটা তো আমার সিদ্ধান্ত না, এটা জনগণের সিদ্ধান্ত।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন
প্রশ্ন: আমরা যদি ধরে নিই, আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় আসছে। সে ক্ষেত্রে সংসদে প্রধান বিরোধী দল কে হতে পারে?

আমীর খসরু: আপনি তো শেখ হাসিনার যুগে ফিরে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিত সে ক্ষমতায় থাকবে, তারপর বিরোধী দল কে হবে, সেকেন্ড বিরোধী দল কে হবে। শেখ হাসিনা কিছু খুদে স্বৈরাচার সৃষ্টি করে গেছে। ওই মনমানসিকতা থেকে এখনো কিন্তু অনেকে বের হতে পারছে না যে আমি সরকার, বিরোধী দল অমুক হবে। এই জায়গায় আর যাওয়া যাবে না। আপনি যদি জনগণের আস্থা ছাড়া রাজনীতি করতে চান তাহলে এ আলোচনা ঠিক আছে। জনগণের আস্থা-বিশ্বাসই বিএনপির রাজনীতি। আমি যদি সেটাই করি, তাহলে সংসদে কারা আসবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাদের কারও নেই।

প্রশ্ন: বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন কেমন? ক্ষমতায় গেলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কী ভাবছেন?

আমীর খসরু: আমাদের রাজনীতি কোনো বিশেষ দল, ব্যক্তি, দেশকেন্দ্রিক না। বিএনপির রাজনীতি বহুপক্ষীয়, মাল্টিলেটারাল। বিএনপি যতবারই ক্ষমতায় ছিল, জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে—আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহুপক্ষীয়। সব দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুপক্ষীয়। ভারত একটি দেশ এবং ভারতের গুরুত্ব তারা আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং এ সবকিছু মাথায় রেখেই আমাদের আগামী দিনের বিদেশ নীতি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার চায় ভারত, সে লক্ষ্যে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে দেশটি। এটা বিএনপিরও চাওয়া। সমালোচকেরা দুটোকে এক করে দেখছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

আমীর খসরু: দুটোকে এক করে দেখার কিছু নেই। এটা তো বাংলাদেশের জনগণেরই প্রত্যাশা। আপনি গণতন্ত্রের কথা বলবেন, তো নির্বাচন ছাড়া কি গণতন্ত্র হবে? আমি আনন্দিত যে ভারত এত দিন পর এই জায়গায় এসেছে। আমাদের এত বড় প্রতিবেশী, যারা নিজেরা গণতান্ত্রিক, তাদের যে এ জায়গায় আসতে এত দিন সময় লাগল, তবু এত দিন পর যে তারা অনুধাবন করতে পারছে বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক সরকার দরকার, এটা ভালো খবর। আমি আশা করব, ভারতের এই চিন্তাটা যাতে অব্যাহত থাকে।

নির্বাচন ঘোষণা তো আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে করা সম্ভব এবং ডিসেম্বরের অনেক আগে (নির্বাচন) করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন বলছে তারা প্রস্তুত, তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রশ্ন: গত আট মাসে বিএনপি মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে; অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর একটি নিবন্ধে সে প্রশ্ন সামনে এনেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির ফলে ক্ষমতার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সে জায়গা দখল করেছেন বিএনপির কর্মীরা। যার ফলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে পুরোনো অভ্যাসের মৃত্যু সহজে হয় না। এ ধরনের অভিযোগে অনেককে বহিষ্কার করা সত্ত্বেও এর দৌরাত্ম্য থামানো যায়নি।’

আমীর খসরু: আমি এ প্রশ্নের উত্তরটা শুরু করব এভাবে, আওয়ামী লীগের সব সময় একটা বক্তব্য ছিল যে তারা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বিএনপি আওয়ামী লীগের লাখ লাখ লোককে খুন করবে। আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ার পরে তাদের কোনো একটা লোককে কী বিএনপি খুন করেছে? বাংলাদেশে যখন তিন দিন সরকার ছিল না, বিএনপি হচ্ছে সবচেয়ে বড় পার্টি। বিদেশের অনেক কূটনীতিক আমাকে বলেছেন, যে তাদের দেশে যদি তিন দিন সরকার ছাড়া থাকত, অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যেত। কিন্তু তোমরা খুব ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করেছ। এটার জন্য বিএনপিকে কৃতিত্ব দিয়েই আমি শুরু করি। এত সমস্যা আছে, আমি যদি বলি কিছুই হচ্ছে না—এটা তো ভুল। এত বছরে বিএনপির অনেকের ব্যবসা তারা (আওয়ামী লীগ) কেড়ে নিয়েছে। অনেকের জায়গাজমি কেড়ে নিয়েছে। অনেককে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেই বিষয়গুলো অনেকে ফিরে পেতে চাচ্ছে বা কোথাও ফিরে পাচ্ছে। এখানে তাদের বলা হচ্ছে যে তারা দখল করছে। এটা একটা দিক।

আবার কোনো কোনো জায়গায় আমাদের কিছু কিছু নেতা-কর্মী যে (দখল-চাঁদাবাজি) করছে না, তা নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিএনপি কী করছে, তা দেখতে হবে। দুই হাজারের ওপরে বহিষ্কার (দল ও সংগঠন থেকে) করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত বহিষ্কার হচ্ছে এবং বহিষ্কার হচ্ছে তদন্ত ছাড়া। আমরা কেন করছি, তারেক রহমান কেন করছেন? উনি সিগন্যাল (সংকেত) দিচ্ছেন যে এ ধরনের লোকের বিএনপিতে কোনো জায়গা নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো দল এতগুলো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এভাবে ব্যবস্থা নেয়নি। বরং অনেক দল এ ধরনের ঘটনার দায় অস্বীকার করেছে। বিএনপি তো এখন ক্ষমতায় নেই, ক্ষমতায় থাকলে হয়তো এদের অনেককে জেলে যেতে হতো। কিন্তু বিএনপি দল হিসেবে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার (সংস্কৃতি) নষ্ট হয়ে গেছে। এটা তো স্বীকার করতে হবে। এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিএনপি নিজে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের একটু সময় লাগতে পারে। যেহেতু আমরা মেনে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটা সমাধানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর লেখা ‘একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পথরেখা’ শীর্ষক নিবন্ধে একটি সতর্কবাণী করেছেন। সেটি হচ্ছে, তিনি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের নেওয়া শাসনব্যবস্থার পরিচালনা ও নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোকে আন্তরিক এবং ব্যক্তি স্বার্থে নয় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের শাসনব্যবস্থা বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের পথ দেখাতে না পারে, তবে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে হতাশা ও অসন্তোষের আরেক যুগের মুখোমুখি হতে পারে।

আমীর খসরু: উনি সঠিক বলেছেন। এই জন্যই বিএনপি ৩১ দফা, এ জন্যই বিএনপি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের কথা প্রকাশ্যে বলছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এ সব ধারণা কিন্তু বিএনপিই নিয়ে এসেছে। মাঝখানে ১৫ বছর যেটা হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই তো আমরা এত ত্যাগ স্বীকার করেছি। উনি যা বলেছেন, আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে এগুলো তো আছে। তারা (আওয়ামী লীগ) এগুলো ডিনাই (নাকচ) করেছে, আমরা তো ডিনাই করছি না। এখানেই হচ্ছে পার্থক্য।

আমরা কোনো ভুল করিনি, এটা তো আমরা বলতে পারব না। ভুল স্বীকার করে আপনি সমাধানের দিকে যাবেন, বিএনপির সফলতাটা এই জায়গায়। এটার ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনে আরও ভালো কিছু করা যায় কি না, সে চেষ্টাই করছে বিএনপি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *