আবারও ভরসার বাতিঘর জেনারেল ওয়াকার

গুজববাজরা গুজব রটাবে, ওপারের ময়ুখরা মলমবাজি করবে, এপার-ওপার মিলিয়ে আজগুবি কনটেনটের হাট বসাবে; এগুলো অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, সুযোগটা কে করে দিয়েছে? কেউ এখানে-ওখানে জয় বাংলা ঘটাবেন, কেউ ইনকিলাব কাত করবেন, জাতীয় ঐক্যের চব্বিশের চেতনাকে বরবাদ করবেন- গুজবের কারবার হবে না কেন? নিজের নানা অপকর্ম ঢাকতে একের পর এক অঘটন ঘটাবেন, তা ঢাকতে বিভিন্ন দিকে আঙুল তুলবেন? সেনাপ্রধানকে এসে বারবার ঐক্যের বারতা দিতে হবে? বলতে হবে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে? আর কত?

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তো এই কদিন আগেও লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ারে জানিয়ে দিয়েছিলেন, মিলেমিশে না চললে সামনে খারাপি আছে। তখন কিন্তু তাঁকে দোষারোপ করা যাবে না। তখন কারও কারও কাছে তাঁর ওই সতর্কবার্তা তিতা লেগেছে। এখন? একজন সেনাপ্রধান আর কতটুকু বলতে পারেন? দেশে একদিকে মীর জাফর, লেন্দুপ দর্জি গজাবে, আরেক দিকে সেনাপ্রধানকে কদিন পর পর তাঁর বাহিনীকে নিয়ে এসে উদ্ধারের বাতিঘর হতে হবে? তা কাহাতক হতে পারে? প্রধান উপদেষ্টাকে কতটা খেলো করা যায়, সেনাপ্রধান বা সেনাবাহিনীকে নিয়ে কোন ভলিউমে কথা বলা যায়, সেই মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলার নমুনাও চলছিল গত কটা দিন ধরে। ক্রমেই গত তিন-চারদিন তা চরমে পৌঁছতে থাকে।

রাজনীতি-কূটনীতি না বোঝা মানুষ বুঝতে পারছিল জাতীয় নিরাপত্তাসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু ঘটে চলছে, আরও ঘটবে। এমন একটা সন্ধিক্ষণে আবার মুখ খুললেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। যতটুকু যা বলার আগেও বলেছেন, এবার আবারও বললেন। গণ অভ্যুত্থানের শরিক ৫ আগস্টের স্ট্যাকহোল্ডারদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গোলমাল, অবিশ্বাস, সরকারের কোনো কোনো অংশের ভিতরের বাঁধন ঢিলা হয়ে যাওয়াসহ তাবৎ পরিস্থিতিতে কী হয়-কী হচ্ছে জিজ্ঞাসার সময়ে তার কয়েক কথার মাঝে কিছু উপাদান খুঁজে পেয়েছে মানুষ। পেয়েছে ভরসা। ১০ কথার কয়েক কথার মতো তিনি নির্বাচিত সরকারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কেন জরুরি। রাষ্ট্রীয় অখ তা-সার্বভৌমত্বের জন্য চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ৯ মাস সেনাবাহিনীকে অবজ্ঞা করার অভিযোগ এনেছেন। ‘রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগ্রহণে সশস্ত্রবাহিনীকে অন্ধকারে রাখা অনুচিত’- এমন আক্ষেপের কথাও জানিয়েছেন। এসবের পর বলার আর কী বাকি থাকে? নির্বাচন প্রশ্নে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কি নতুন কিছু বলেছেন? এ বিষয়ে আগের অবস্থানেই তিনি। গেল সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হয়, সেই ভূমিকা রাখবেন। কথা রেখেছেন। যথারীতি নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। বুধবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন। নির্বাচন ছাড়াও করিডর, বন্দর, সংস্কারসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে তার বক্তব্যে।

প্রশ্নের সোজাসাপ্টা বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। তা করতে হবে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক ঐকমত্য) মাধ্যমে সেটা হতে হবে। ‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা আক্রমণের বিরুদ্ধেও কঠোর বার্তা দিয়েছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী সামনে আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়েও কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। তার সাফকথা, এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

সংস্কার প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। এ বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ বা আলোচনা করা হয়নি। এও বলেছেন, সেনাবাহিনী কখনোই এমন কোনো কার্যকলাপে যুক্ত হবে না, যা জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর। তিনি সব পর্যায়ের সেনাসদস্যদের নিরপেক্ষ থাকার এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনি দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের নির্দেশ দেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করছি, করে যাব।’

বলার আর কিছুই বাকি রাখেননি জেনারেল ওয়াকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সহযোগিতা এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতির মাঝে কত বড় রকমের আশাব্যঞ্জক ম্যাসেজ তিনি দিয়েছেন! বৃহস্পতিবার বিএনপি-এনসিপি নেতাদের এমন মাতবোলের একদিন আগে বক্তব্যটি দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে ছিল প্রধান উপদেষ্টার অভিমান করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জোর গুঞ্জন। ওই রকম সময়ে দরকার ছিল একটি স্বস্তির বারতা। এর আগে, একবার ৫ আগস্টের আগে তার বাহিনীকে ‘নো ফায়ার’ নির্দেশ দিয়ে জীবদ্দশাতেই নতুন ইতিহাস হয়েছেন। মাস কয়েক আগে, সবাইকে বাস্তবতা উপলব্ধির সতর্কতা দিয়ে বলেছিলেন, ‘পরে কিছু ঘটলে যেন তাকে দোষারোপ করা না হয়’। বুধবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য আরও ঝরঝরে।

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোধগম্য, যে কোনো দেশের সশস্ত্রবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হালকা কথা বললে তাদের মনোবলে টোকা পড়ে। বহিঃশত্রুদের মাঝে এতে তৃপ্তির ঢেকুর আসে। তারা সুযোগ নেওয়ার সাহস পায়। এতে অনিবার্যভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। যা দেশটির জন্য ভীষণ আত্মঘাতী। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা সেই অপেক্ষাই করছে। সচেতন নাগরিকরা গত দিনের আলামতে তাই উদ্বিগ্ন। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদার, দক্ষ, প্রত্যয়ী। উঁচু মনোবলে কেবল নিজেরা নয়, জনতাকে নিয়েও ঐক্যবদ্ধ। বাহিনী প্রধানের ক্যারিশমা-বিচক্ষণতা-পেশাদারিত্বে মুগ্ধ। অফিসার, সৈনিক, এমনকি সেনাপ্রধানের একসূত্রে গাঁথার এ নজিরের মাঝে যে কোনো একজনের প্রতি কেউ অসম্মান করলে তার আঁচড় সবার গায়ে লাগে। তাদের কাছে এটি পুরো বাহিনীর প্রতি অসম্মান বলে মনে হয়। এ ছাড়া বর্তমান সেনাবাহিনী আর আগের সেনাবাহিনী এক নয়। ৫ আগস্টে সেনা-জনতা এক কাতারে হয়ে ভিন্ন আবহ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে।

এরপরও পরিকল্পিত নানা খোঁচা ও উসকানি সইতে হচ্ছিল সেনাপ্রধান ও তার বাহিনীকে। এর আগে, রাওয়া ক্লাবের অনুষ্ঠানে যদ্দূর সম্ভব সবাইকে সতর্ক করেছেন। বলেছেন, পরে যেন কেউ তাকে দোষারোপ করতে না পারেন। চাইলে তো সেই সতর্কতা না দিলেও পারতেন। বসে বসে মজা দেখতেন। কিছুদিনের ব্যবধানে আবারও সতর্কবার্তার সঙ্গে পরামর্শও রাখলেন সেনাপ্রধান। চৌকশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের চব্বিশের ম্যাজিক রক্তপাত থেকে বাঁচিয়ে দেশকে একটি পথরেখা দিয়েছে। তার ক্ষমতালিপ্সা নেই, তাও প্রমাণ হয়েছে। চাইলে এ ক্ষমতার লিপ্সা চরিতার্থ করার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল। এখনো আছে। কিন্তু তিনি সেই পথের পথিক নন। কিন্তু নির্বাচন আয়োজনে দেরির কারণে অবান্তর কিছু কথা রটছে। এবার সেই বিষয়টি নতুন করে ক্লিয়ার করলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। যা এটি সুন্দর আগামীর পথরেখা দিতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *