এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বস্তি স্থায়ী হবে কি না? সংকটের গভীরতা বা উভয় পক্ষের মধ্যে দূরত্ব কতটা প্রকট ছিল, তার ওপরেও কিন্তু স্বস্তির স্থায়িত্ব কিছুটা নির্ভর করে। সাধারণভাবে যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল, তা হলো বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অবশ্য এ সন্দেহ দলটির নেতৃত্বের মধ্যে যতটা না দেখা যাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি প্রকট ছিল মাঠ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া ধৈর্যহারা লোকজনের এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রবক্তাদের কথাবার্তায়। অন্তব৴র্তী সরকারের সমর্থকদেরও একটি অংশ সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়, ইউনূস সরকারকে ৫ থেকে ১০ বছর সুযোগ দেওয়ার পক্ষে যে প্রচার শুরু করে, তা–ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অবিশ্বাস তৈরির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রমজান যেহেতু মধ্য ফেব্রুয়ারির পরপরই শুরু, সেহেতু নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো আপত্তি নেই।

সাধারণভাবে যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল, তা হলো বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। অবশ্য এ সন্দেহ দলটির নেতৃত্বের মধ্যে যতটা না দেখা যাচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি প্রকট ছিল মাঠ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া ধৈর্যহারা লোকজনের এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রবক্তাদের কথাবার্তায়।
বিপরীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও যে ন্যূনতম সংস্কার এবং বিচারের জন্য সময়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছেন, তাতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে বাস্তববাদিতার প্রতিফলন ঘটেছে। এগুলো সম্পন্ন করার জন্য কোনোভাবেই বাড়তি সময় দেওয়া যাবে না, এমন কোনো অনমনীয় অবস্থান তিনি নেননি। নির্বাচনের সময় নিয়ে উভয় পক্ষের এ নমনীয়তা উভয় পক্ষের মধ্যে আপাতদৃষ্টে সৃষ্টি হওয়া দূরত্বের অবসান ঘটিয়েছে। এরপর মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমান দুজনে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট একান্তে আলোচনা করেছেন।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের মধ্যে যে ধরনের সন্দেহ–সংশয় দেখা যাচ্ছিল, তা যে কখনো কখনো শালীনতার সীমাও ছাড়িয়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বেশ কিছু ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন; কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল কি না, সেই প্রশ্ন তাঁদের ভেবে দেখতে হবে। বড় দলে শৃঙ্খলা প্রতিপালন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, সন্দেহ নেই। স্বৈরাচারমুক্ত দেশকে সবাই নতুন বাংলাদেশ বলতে চাইলে বড় দলকে এ চ্যালেঞ্জে সফল হতে হবে।
সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার সাক্ষাতের ৯০ শতাংশের মতো সময় যে তাঁরা একান্তে আলোচনা করলেন, তাতে কী কী প্রসঙ্গে কথা হয়েছে, তা নিয়ে নানা রকম জল্পনা চলতে পারে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বরাতে জানা যাচ্ছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের ভাবনা ও পরিকল্পনাগুলো তারেক রহমান মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তুলে ধরেছেন।
অর্থনৈতিক নীতি কিংবা পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক বিতর্ক যেভাবে হয়েছে, তা–ও কিন্তু সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির অন্যতম কারণ। অন্তর্বর্তী সরকার যে অর্থনীতিতে একটা স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পেরেছে এবং আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তির অব্যাহত অপপ্রচারের পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে, এগুলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের কাজ অনেকটাই সহজ করে দেবে। না হলে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সরকার গঠিত হলেই যে তা এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে সক্ষম হতো, এ কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না।
বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর কারণে অন্য কারও সঙ্গে যেন দূরত্ব তৈরি না হয়, সেটাও কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বিএনপির প্রতি ঈর্ষাকাতর বা বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা আছে, এমন দু–একটি দল লন্ডনের এ বৈঠককে ইতিবাচকভাবে না–ও নিতে পারে। নির্বাচনের সময় প্রশ্নে ছাড় দিয়ে বড় দলের প্রতি আনুকূল্য দেওয়া হলো কি না—এমন প্রশ্ন তারা তুলতে পারে। কেননা, আমরা ইতিমধ্যে ছাত্রদের গড়ে তোলা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও তার পৃষ্ঠপোষকদের মুখ থেকে বিএনপির প্রতি অভিযোগ তুলতে শুনেছি যে তারা সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ সমালোচনা অযৌক্তিক নয়; কিন্তু তা যেন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্য উসকে না দেয়, সেদিকেও সবার নজর রাখা দরকার।
সাধারণভাবে রাজনীতিবিতৃষ্ণ ব্যাংকার–অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপির নেতার এসব ভাবনায় চমৎকৃত হয়েছেন বলেই শুনেছি। ভবিষ্যতে এগুলো বিশদে জানার কৌতূহল আমাদের আপাতত সংবরণ করতেই হচ্ছে।
লন্ডনের বহুপ্রতীক্ষিত বৈঠকটি নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে সৃষ্ট মতভেদ দূর করার প্রত্যাশা যে পূরণ করেছে, তার পেছনে অধ্যাপক ইউনূসের লন্ডনের অন্য একটি আলোচনারও কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ১১ জুন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বা চ্যাথাম হাউসের আয়োজনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় তিনি বেশ কয়েকটি বিষয়ে তাঁর অবস্থান খোলাসা করেছেন। তাঁর পরিকল্পনা ও ভাবনা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠছিল, তার বেশ কয়েকটির সোজাসাপটা উত্তর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারকারীদের সৃষ্ট ধোঁয়াশা অপসারণ করেছে। ওই আলোচনায় ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের বিষয়টি তিনি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং গণভোটের ধারণাও নাকচ করে দেন। বহু সমালোচক অভিযোগ করে আসছিলেন যে ডিসেম্বর ২০২৫-এর পর নির্বাচন বিলম্বিত করার পেছনে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তাঁদের দাবি ছিল, একটি গণভোটের মাধ্যমে তাঁর ম্যান্ডেট দীর্ঘায়িত করা হতে পারে। ইউনূসের স্পষ্ট বক্তব্য এসব সন্দেহ অনেকটাই দূর করে।
পরিবেশ ও ব্যক্তিপর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগের শক্তি—এই দুটি বিষয়ই মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মানতেই হবে, উপহার নির্বাচনও ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার সময় তারেক রহমান তাঁকে একটি কলম ও দুটি বই উপহার দিয়েছেন। বই দুটির একটি হচ্ছে নেচার ম্যাটার্স এবং অন্যটি নো ওয়ান ইজ ঠু স্মল টু মেক আ ডিফারেন্স। দ্বিতীয় বইটি পরিবেশবাদী আন্দোলনের বর্তমানের সবচেয়ে পরিচিত মুখ গ্রেটা থুনবার্গের লেখা। পরিবেশ ও ব্যক্তিপর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগের শক্তি—এই দুটি বিষয়ই মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মানতেই হবে, উপহার নির্বাচনও ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ।