জনতার কণ্ঠ রিপোর্টার: ৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ। জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয় ভুয়া তথ্যে। ব্যাংকে দেওয়া হয় ঘুষ। ইসি কর্মীসহ ১৩ জনের যোগসাজশ।
একেকটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র করতে ৩৫-৪০ হাজার টাকা লাগত।
মোট ঋণের ১০% ঘুষ হিসেবে দিতে হতো।
অভিযোগপত্রে কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার নামে আসেনি।
ঋণ নিতে দুদিকেই জালিয়াতি: ব্যাংক থেকে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার এক মামলায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তাদের তদন্তে উঠে এসেছে যে এই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি হয়েছে দুই দিকে।
এক দিকে অভিযুক্তরা ভুয়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করেছেন, অন্যদিকে ব্যাংকেও দিয়েছেন ভুয়া তথ্য। দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করার সঙ্গে জড়িত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দুজন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম রয়েছে। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নাম নেই।
জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে মামলার আসামি হওয়া ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন ঋণগ্রহীতা আবদুল্লাহ আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী রোজিনা রহমান, আবদুল মজিদ, এম এ হানিফ মিয়া (মিলটন), ইয়াছির আরাফাত, ছালেহ আহম্মেদ আজাদ, জাবেদুল আনোয়ার খান ও সাদিয়া নাসরিন।
এই জালিয়াতিতে একটি চক্র কাজ করেছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির বিষয়ে জানা যায়।
এ কে এম হাফিজ আক্তার, অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশ দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হলেন সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলাম। তাঁরা নির্বাচন কমিশনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সুমন পারভেজ, মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মো. মজিদ ঋণ জালিয়াতিতে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেছেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নির্বাচন কমিশনের এই দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটরসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর এক বছর তদন্ত শেষে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে এই অভিযোগপত্র দেয় ডিবি।
ডিবির দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, এই জালিয়াতিতে একটি চক্র কাজ করেছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির বিষয়ে জানা যায়। নির্বাচন কমিশন ডিবিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে।
যেভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি: ঋণ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ। ডিবির অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, তিনি ভুয়া তথ্য দিয়ে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঋণ নেন। সেই ঋণ আর পরিশোধ করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় নাম ওঠায় তিনি নতুন করে ঋণ নিতে পারছিলেন না। পরে ভিন্ন তথ্য দিয়ে তিনি আরও একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। সেটি দিয়ে ৪৭ লাখ টাকা ঋণ নেন।
ডিবি জানিয়েছে, আবদুল মজিদ দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন আঙুলের ছাপ, চোখের মণির (আইরিশ) প্রতিচ্ছবি দেওয়াসহ সাতটি ধাপ পার হওয়ার পর। দ্বিতীয়বার আঙুলের ছাপ বা চোখের মণির প্রতিচ্ছবি নেওয়ার সময়ই বিষয়টি ধরা পড়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের সহায়তার কারণে জালিয়াতি ধরা পড়েনি।
নির্বাচন কমিশনের এই দুই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর কমিশনের তথ্যভান্ডারে (সার্ভারে) প্রবেশ করে তথ্য হালনাগাদ করতে পারতেন। ডিবি বলছে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা ঘুষের বিনিময়ে মানুষকে দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন। একেকটির জন্য তাঁরা ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা নিতেন।
ডিবি জানায়, নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে তারা জানতে পেরেছে যে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭ হাজার ৩৩২ জন দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র করেছেন। কমিশন এ কাজে সহায়তার অভিযোগে ৪৪ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে। মামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে ৯২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ধরনের অনিয়ম নির্বাচন কমিশন প্রশ্রয় দেয় না।
ঋণের ১০% ঘুষ: আবদুল মজিদ ঋণ নিতে শুধু দ্বৈত জাতীয় পরিচয়পত্র নয়, ভাড়াটে নিবন্ধন ফরম থেকে শুরু করে কোনো নথিপত্রেই সঠিক ঠিকানা ব্যবহার করতেন না। বাকি সাতজনও একইভাবে ভুয়া তথ্য দিয়ে ঋণ নিয়েছেন।
ডিবির অভিযোগপত্রে নাম আসা সুমন পারভেজ ও মো. মজিদ ব্যাংকে ঋণ পাইয়ে দিতে দালাল হিসেবে কাজ করতেন। ডিবি সূত্র জানিয়েছে, তাঁরা অসাধু ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র করা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগসাজশ করে ঋণের ব্যবস্থা করে দিতেন। ব্যাংকঋণ পেতে মোট ঋণের ১০ শতাংশ ঘুষ হিসেবে দিতে হতো।
মামলার তদন্ত তদারকির সঙ্গে যুক্ত ডিবির সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস প্রথম আলোকে বলেন, এই দুজন ব্যাংকে খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিতেন।
অবশ্য ডিবির অভিযোগপত্রে কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার নাম আসেনি।