এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতরণ করা ব্যাংকঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আবার দেশের অর্থনীতিতে বর্তমান মন্দাবস্থার কারণেও বহু ব্যবসায়ীর ঋণ খারাপ হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া নতুন নীতিমালার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ভালো-খারাপ প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশে সর্বশেষ জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বেশিই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। গত মার্চের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলো এ রকম তথ্যই উল্লেখ করেছে।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা এ বছরের জুনে বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।

■ জুনে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা গত মার্চে ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। ■ ভালো ও খারাপ সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণই গত জুনে বেড়েছে। ■ নতুন নীতিমালার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে অভিযোগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আবার ঋণ খেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয় তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালীরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে। সেই সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয় একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে খেলাপি ঋণে জর্জরিত পাঁচ ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণ ৭০ শতাংশ।

সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি সরকারি খাতের অগ্রণী ও জনতা এবং বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ইউসিবি, এনআরবি ও এনআরবি কমার্শিয়ালসহ বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

এদিকে খেলাপি হয়ে পড়া ১ হাজার ২০০ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিশেষ বিবেচনায় নবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শতাধিক ব্যবসায়ীকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নীতি–সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ব্যাংকগুলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *