মাহবুবুল আলম কবীর
‘উঁহু, উয়া অইবে না। আলিনূর যদি এই গুরুপে থাহে, মুই কিন্তু নাই। এই আমি কইয়্যা দিলাম।’ সেন্টু ফস করে ঘোষণাটা দিয়ে দিল। কথা হচ্ছিল আমাদের পাঁচজনের একটা দল গঠন নিয়ে। না, খেলার দল নয়, খেলা দেখার দল। পরের দিন জয়দেবপুর রাজবাড়ি মাঠে আন্তস্কুল ফুটবলের ফাইনাল খেলা। আমাদের টঙ্গী পাইলট হাইস্কুল ফাইনালে উঠেছে। মোটামুটি ১২ কিলোমিটার দূরের মাঠে যাওয়ার জন্য স্কুল থেকেই বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবু একসঙ্গে ঘোরা, পাশাপাশি বসে খেলা দেখা আর গলা ফাটিয়ে চিল্লাফাল্লা করে নিজেদের টিমকে উৎসাহ জোগানোর জন্য একটা ছোটখাটো দল পাকানো দরকার। আমরা সেই চেষ্টাই চালাচ্ছি।
আমরা মানে ক্লাস সেভেনের পাঁচজন—আমি, সেন্টু, জনি, রানা আর আলিনূর। কিন্তু সেন্টু ভেটো দিয়ে বসল আলিনূরের বিপক্ষে। বরিশালের ছেলে সেন্টু বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে মাতৃভাষায় কথা বলার চেষ্টা চালায় আর একই বাক্য দুবার বলে। জনি ওকে বোঝানোর চেষ্টায় ডান হাতের পাঞ্জাটা ট্রাফিক পুলিশের মতো উঁচিয়ে ধরে। এর মাঝেই ট্রাফিক সিগন্যাল না-মানা বেয়াড়া ড্রাইভারের মতো সেন্টু গড়গড় করে ওর মিশন কমপ্লিট করল: ‘মুই কইতেয়াছি, আলিনূর যদি এই গুরুপে থাহে, মুই কিন্তু নাই।’ বুঝলাম ব্যাপার গুরুতর। আলিনূরের ব্যাপারে সেন্টু খেপে গেছে।
খ্যাপারই কথা। আমাদের ক্লাসে, শুধু ক্লাসে বললে ভুল হবে, বলা যায় গোটা স্কুলেই এবং স্কুলের বাইরেও ‘বেআক্কেল’ হিসেবে আলিনূরের বেশ নামডাক আছে। মাঝেমধ্যে অন্য স্কুলের ছেলেরাও আমাদের স্কুলে ঘুরতে আসে, বেড়াতে আসে। আমাদের শিক্ষকেরা যতই খুশি হয়ে ভাবুন না কেন যে অন্য স্কুলের ছেলেরা এই নামকরা স্কুল দেখতে আসে, আসলে বিষয়টা ভিন্ন। আমরা ঠিকই বুঝি ওরা আসলে দেখতে আসে আলিনূরকে! এই তো গত সপ্তাহেই আশপাশের তিনটি স্কুলের অন্তত গোটা দশেক ছেলে টিফিন পিরিয়ডে আমাদের স্কুলে ঘুরতে এল। তখন হেডস্যার তো সিনা টান করে বারান্দায় পায়চারি করছেন আর আগন্তুক ছাত্রদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি গর্বের হাসি হাসছেন। ওদিকে ওই ডেলিগেট দলেরও মুখে হাসি। ওরা পুরো স্কুল না দেখে শুধু আমাদের ক্লাস সেভেনের আশপাশেই চক্কর মারল আর আলিনূরকে প্রাণভরে দেখে নিল। কেন? কারণ তার আগের দিন আলিনূর একটা ঘটনা ঘটিয়েছে। সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে স্যার পড়াচ্ছিলেন, পেছনের বেঞ্চিতে বসে তখন আলিনূর আর মোমেন গণি খাতায় কাটাকুটি খেলছিল। স্যার হঠাৎ হাঁক দিলেন, বল তো দেখি, যাহা পূর্বে ছিল এখন নাই—এইটা এক কথায় কী হবে? তখুনি স্যারের নজরে পড়ল আলিনূরের ক্লাসে মনোযোগ নেই, ঘাড় গুঁজে কী যেন করছে। সুতরাং, তার নামেই সমন জারি হলো।
: আলিনূর দাঁড়া দেখি, তুই-ই বল।
: কীক্…কীক্…কী বলব স্যার ? ভ্যাবাচেকা খেয়ে তোতলাতে থাকে বেচারা।
: যাহা পূর্বে ছিল এখন নাই—এইটা এক কথায় কী হবে?
ট্রেনের গতি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদেরও বুকের ধুকপুকানি। আলিনূর হাত ছাড়াতে চাইছে, যুবকটি টেনে তুলতে চাইছেন। টান টান উত্তেজনা!
সমাজবিজ্ঞান ক্লাসে বাংলা ব্যাকরণের প্রশ্নটা আলিনূরের মাথার নেটওয়ার্কে ধরতে পারে না। হয়তো ও ভাবল এর একটা সমাজতাত্ত্বিক জবাবই দেওয়া উচিত। তাই আমতা-আমতা করে বলল, ‘স্যার, এইটা পূর্ব পাকিস্তান।’ পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। স্যার কতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক তক্ষুনি ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় ব্যাপারটা আর আগে বাড়েনি।
কিন্তু এমন একটা মুখরোচক খাবারের মতো খবর কি চাপা থাকে? থাকে না। তার ওপর আমাদের ক্লাসের একেকটা ছেলেও যেন বিবিসি-সিএনএনের স্বেচ্ছাসেবী সংবাদদাতা। ওই দিন সূর্যাস্তের আগেই সারা এলাকায় ব্রডকাস্টিং শেষ। তাই পরের দিন আশপাশের স্কুল থেকে ছাত্ররা টিফিন পিরিয়ডে আমাদের স্কুলে শিক্ষাসফরে এল। আলিনূরকে চর্মচক্ষে দেখে যাওয়া তো শিক্ষাসফরেরই শামিল! কেউ কেউ হয়তো একটু ছুঁয়েও দেখার আশা করেছিল, কিন্তু আলিনূরের পেশিবহুল শরীর দেখে আর সাহস করেনি।
তবে এই বোকামির সঙ্গে সেন্টুর রাগের কোনো সম্পর্ক নেই। আলিনূরের ওপর সেন্টুর রাগের কারণ আরও গভীরে লুকায়িত, আরও শোকাবহ। ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলছি। ঘটনাটা ঘটেছিল আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৮২ সালের আন্তস্কুল ফুটবলের ফাইনালে। ফাইনালে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম রানী বিলাসমণি হাইস্কুলের। ধারে না কাটলেও ভারে কাটতে হবে—এই বিশ্বাসে ওদের দলের ডজন খানেক সমর্থক হকিস্টিক নিয়ে খেলা দেখতে আসে। আর তারা মাঠের এমন এক কোণে জাঁকিয়ে বসে, যার মাঝখানে পড়ে যায় আমাদের আলিনূর আর সেন্টু। বিপদ টের পেয়ে সেন্টু চুপ। আর আলিনূরটা করে কী, আমাদের দলের কারও পায়ে বল যেতেই অতি উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে। ব্যাপার দেখে হকিস্টিকওয়ালারা আলিনূরকে যেন চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে—এমনভাবে তাকায়। বাঘের দল যে ঘিরে রেখেছে, বেচারা খরগোশ তা টেরই পায় না। হঠাৎ আলিনূর খোশমেজাজে আঙুল তুলে হকিস্টিকওয়ালাদের দেখিয়ে সেন্টুকে বলে, ‘দ্যাখ দ্যাখ দোস্ত, কত বড় বেক্কল! এরা হকি খেলার সাপোর্ট করতে আইসা দেখে ফুটবল চলতাছে!’ ব্যস, আর যায় কোথায়, শুরু হয়ে গেল পেঁদানি। সেন্টু যেহেতু আলিনূরের দোস্ত বলে প্রমাণিত, তাই ওকেও বঞ্চিত করা হলো না। খেলার প্রথমার্ধের বিরতির আগেই আলিনূর-সেন্টুকে নেওয়া হলো হাসপাতালে। ডাক্তার ওষুধপথ্য দিয়ে বললেন, এক সপ্তাহ বেডরেস্ট। কিন্তু সেই এক সপ্তাহের প্রথম চার দিন বেডে চিত হয়ে রেস্ট নিতে পারেনি ওরা। কাত হয়েই শুয়ে থাকতে হয়েছে। চিত হবে কীভাবে? ডাক বিভাগের সিলের মতো পিঠের ওপর চার-পাঁচটা করে হকিস্টিকের জলছাপ ছিল যে!
এই কারণেই আলিনূরের সঙ্গে খেলা দেখতে যাওয়ার কথা উঠতেই সেন্টুর পিঠের ব্যথাটা চিনচিন করে ওঠে। ওকে আমরা দোষও দিতে পারি না। কবি যথার্থই বলেছেন, ‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে…’! আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আলিনূর মিনমিন করে কী যেন বলার চেষ্টা করে, কিন্তু যে পরিমাণ ঠোঁট নড়ে সেই অনুপাতে আওয়াজ বেরোয় না। আহারে বেচারা! ওর জন্য আমাদের বাকি তিনজনের খারাপই লাগে। শেষে রানা সেন্টুর পিঠে হাত বুলিয়ে যাত্রাদলের বিবেকের মতো একটা সমঝোতার চেষ্টা চালায়। কী মোলায়েমভাবে যে হাত বুলায়! আমাদের পাড়ার সেলুনের বিশু নাপিতও এত মোলায়েমভাবে মাথা ম্যাসাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না। রানা যেন সেন্টুর পিঠের সেই ক্ষতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, আর বলছে, ‘শোন দোস্ত, পাস্ট ইজ পাস্ট (এই নতুন ইংরেজি বাক্যটা আমরা আজকেই শিখেছি, ইংরেজি গ্রামার ক্লাসে কাশেম স্যার বলেছিলেন)। আলিনূর ওর বোকামির জন্য অনুতপ্ত। এত দিন ধরে আমাদের সঙ্গে আছে, আজ কেন ওকে ত্যাজ্যবন্ধু করব? ও আমাদের সঙ্গে থাকুক, কিন্তু শর্ত হচ্ছে আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করতে পারবে না, কথাও বলা নিষেধ।’
শেষমেশ রফা হলো। এখন যাওয়ার পরিকল্পনা। ঠিক হলো, আমরা স্কুলের ভাড়া করা বাসে যাব না। কারণ, ওই বাসে চার-পাঁচজন শিক্ষক আমাদের পুলিশের মতো পাহারা দিয়ে যাবেন। আর আমরা জেলখানার কয়েদিদের মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনে চড়ে যাব। টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে বেলা দুইটার ট্রেনে উঠব, হইচই-আনন্দ করতে করতে ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাব জয়দেবপুর স্টেশনে। ওখান থেকে হেঁটে রাজবাড়ি মাঠ পাঁচ মিনিটের পথ। খেলা দেখে ফেরার ট্রেন না পেলে তখন নাহয় স্কুলের বাসেই আসব।
পরের দিন টঙ্গী রেলস্টেশনে আমরা চারজন সময়মতো হাজির। কিন্তু আলিনূরের পাত্তা নেই। দুইটার ট্রেন সোয়া দুইটায় এসে থামল স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু আলিনূর এল না। ভাগ্যিস ট্রেন ছাড়তে আরও ১০ মিনিট লাগবে। কী একটা ঝামেলা যেন হয়েছে। তাই আলিনূরের জন্য আরও ১০ মিনিট এক্সট্রা টাইম পাওয়া গেল। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী ট্রেনটা এসে থামল ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির ভেতরে গরম, তাই আমরা নিচেই পায়চারি করছি। দুই ট্রেনের মধ্যিখানে অনেক যাত্রীর মতো আমরাও হাঁটছি, আর চানাচুর খাচ্ছি। সে সঙ্গে মনের রাগ প্রকাশ করছি অনুপস্থিত আলিনূরের প্রতি। একসময় স্টেশনের দক্ষিণ প্রান্তে দেখা দিল আলিনূর। উত্তর প্রান্ত থেকে আমরা হাত তুলে ওকে চিত্কার করে ডাকলাম। কিন্তু স্টেশনের যাত্রীদের কোলাহল আর চলন্ত ট্রেনের আওয়াজে আমাদের ডাকাডাকি ওর কানে যাচ্ছে না। আলিনূর একবার এই ট্রেনের দিকে তাকায়, আরেকবার ওই ট্রেনের দিকে। পরীক্ষার হলে আধা পরিচিত মাল্টিপল কোয়েশ্চেন সামনে পড়লে যেমন হয়, ওর এখন সেই দশা। মনস্থির করতে পারছে না কোনটাকে বেছে নেবে! ঠিক তখুনি তীব্র হুইসেল বাজিয়ে চলতে শুরু করল চট্টগ্রামের ট্রেনটি। শেষমেশ মনে মনে হিসেব কষে ও বুঝে নিল—আড়াইটা পর্যন্ত জয়দেবপুরের ট্রেন বসে থাকার কথা না, সুতরাং চলন্ত ট্রেনটায় ওঠার জন্য দৌড়াতে শুরু করল ও। আমরা ওর ৩০ গজ সামনেই। চিৎকার করে ওকে থামানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না।
যে দরজাটার হাতল ধরার জন্য আলিনূর দৌড়াচ্ছে, সেখানে এক যুবক দাঁড়িয়ে। তিনিও খেয়াল করলেন একটি কিশোর ছেলে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছে। আহারে! ছেলেটা ট্রেন মিস করলে চিটাগাং যাবে কী করে—এই ভেবে যুবকটি হাত বাড়িয়ে দিলেন আলিনূরকে সাহায্য করতে। আমরা দূর থেকে হায় হায় করছি, আর ভাবছি অপ্রয়োজনের সময় কেন যে মানুষ এত উপকার করতে চায়!
ছুটন্ত আলিনূরের কবজির ওপরে খপ করে ধরে ফেললেন সেই যুবক। এই সময় কয়েক গজ সামনেই আমাদের দেখতে পেল আলিনূর। নিজের বোকামিটা এবার বুঝতে পারল ও। সে সঙ্গে উপলব্ধি করল এই বোকামির মাশুলটাও অনেক বড় হবে। এ সময় ওর চেহারার যা অভিব্যক্তি হলো—বাজি ধরে বলতে পারি লেওনার্দো দা ভিঞ্চিকেও তা আঁকতে দিলে গলদঘর্ম হয়ে যেতেন! কিন্তু এখন যে ফেরার উপায় নেই। চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো তিন গুণ শক্তিশালী যুবক ওর হাত ধরে টেনে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। আলিনূর মরিয়া হয়ে হাত ছাড়াতে চাইছে, আর অতিশয় পরোপকারী যুবকটি যেন মনে মনে বলছেন—হাল ছেড়ো না ভাই, আমি তো আছি, তোমাকে রেখে আমি চিটাগাং যাচ্ছি না। ঠিক যেন—‘আমার মায়ের নোলক ছাড়া ঘরকে যাব না!’
ট্রেনের গতি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদেরও বুকের ধুকপুকানি। আলিনূর হাত ছাড়াতে চাইছে, যুবকটি টেনে তুলতে চাইছেন। টান টান উত্তেজনা! এই টানাটানিতে যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে আমাদের শরীর অবশ হয়ে আসছে। শত শত লোক দেখছে আর হায় হায় করছে। উত্তেজনা যখন চরমে ঠিক তখন…তখনই আমাদের সহজাত বোকাসোকা বন্ধুটি আমাদের ছেড়ে চলে গেল। হ্যাঁ, একটা লাফ দিয়ে চট্টগ্রামের ট্রেনে উঠে পড়ল ও।
এই প্রথম আলিনূর আমাদের কাছে একটা বুদ্ধিমান হিরো হয়ে গেল। বুকের খাঁচায় অনেকক্ষণ আটকা থেকে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস আঁকুপাকু করছিল। এবার তাকে মুক্ত করে দিয়ে আমি বন্ধুদের বললাম, কবরে যাওয়ার চেয়ে চট্টগ্রাম যাওয়াই ভালো।