কাটল না শুল্কসংকট যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনা শেষ

শুল্ক নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় দফার বাণিজ্য আলোচনা শেষ হয়েছে। কিন্তু শুল্কসংকট কাটেনি। আলোচনার তৃতীয় ও শেষ দিনে উভয় দেশ বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আন্তমন্ত্রণালয় আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উভয় পক্ষ। তবে বেশির ভাগ ইস্যুতে সমঝোতা হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই শুল্কহার নিয়ে একটা ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছানো যাবে বলে আশাবাদী সরকার।

আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব বাংলাদেশি পণ্যে অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। এতে তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু প্রধান রপ্তানি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত ৯ থেকে ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। এ ব্যাপারে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, বৈঠকে কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত থাকলেও আলোচনায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে। অনেক বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ। তিন দিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আশাবাদী যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই একটি ইতিবাচক অবস্থানে পৌঁছানো যাবে। আন্তমন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলবে এবং দুই দেশের প্রতিনিধিরা আবারও বৈঠকে বসবেন। সেই আলোচনা ভার্চুয়ালি এবং সামনাসামনি উভয়ভাবেই হতে পারে। খুব শিগগিরই সময় ও তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন, বাণিজ্য সচিব ও অতিরিক্ত সচিব আবারও যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়ে এর আগেও দেশটির সঙ্গে আলোচনায় বসে বাংলাদেশ। আশা করা হচ্ছিল বাংলাদেশি পণ্যের ওপর থেকে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে গত ৭ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৪টি দেশের নেতাদের চিঠি পাঠান, যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম। চিঠিতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেন, ‘আপনার দেশের বাজার আমাদের জন্য উন্মুক্ত করলে এবং শুল্ক ও অশুল্ক বাধা তুলে নিলে, আমরা এই চিঠিতে উল্লিখিত ৩৫ শতাংশ শুল্কহার পুনর্বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে ঘোষিত এই শুল্কহার বৃদ্ধি বা হ্রাস উভয়ই হতে পারে।’ তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আপনাকে হতাশ করবে না।’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে ৩৫ শতাংশ হার এখনো যথেষ্ট নয়। তবে আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপন করেন, তাহলে কোনো শুল্কই থাকবে না, বরং দ্রুত অনুমোদন পেতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’

ট্রাম্পের এই চিঠির দুই দিনের মাথায় দুই দেশের প্রতিনিধিরা আবারও আলোচনায় বসে। আলোচনায় বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন দেশটির ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) অ্যাম্বাসাডর জেমিসন গ্রিয়ার। তিন দিনের আলোচনা সমন্বয় করে ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস। গত শুক্রবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন ও জেমিসন গ্রিয়ারের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা উভয় দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দুই পক্ষই পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে এবং উভয় দেশই বাণিজ্য ও বিনিয়োগে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদারে অঙ্গীকারবদ্ধ।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে এবং বেশির ভাগ ইস্যুতে সমঝোতা হয়েছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আশা করছি। যদিও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি, তবে ধারণা করা হচ্ছে শিগগিরই ট্রাম্প প্রশাসন নতুন শুল্কহার চূড়ান্ত করে জানাবে। তবে রপ্তানি প্রবাহ যাতে বিঘ্নিত না হয় এজন্য বিকল্প প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ আলোচনা কেবল শুল্ক নিয়েই নয়, বরং বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি বড় পরীক্ষা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। এ আলোচনার ফলাফল বাংলাদেশের রপ্তানি শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি শুল্কহারে ছাড় পাই, তবে সেটি শুধু অর্থনৈতিক স্বস্তিই নয়, বরং কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *