জনতার কণ্ঠ ডেস্ক: কোমরের ব্যথা একটি অতি পরিচিত শব্দ যা কমবেশি সব মানুষের হয়। এই ব্যথা শৈশব থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সব বয়সেই হতে পারে। মানব শরীরের মেরুদণ্ড (ব্যাক বোন) অনেক হাড় (কশেরুকা) দিয়ে তৈরি এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত থাকে। নিচের অংশকে (ল্যাম্বো স্যাকরাল রিজিওন) সাধারণত কোমর বা মাজা বলে। শতকরা ৯০ ভাগ লোক জীবনের কোনো না কোনো সময়ে কোমর ব্যথায় ভোগে। শতকরা ৫০ ভাগ লোক একের অধিকবার কোমর ব্যথায় ভোগে। শতকরা ৮৫ ভাগ লোকের ক্ষেত্রে কোমর বা মাজা ব্যথার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। সারা বিশ্বজুড়ে শুধু কোমর ব্যথার কারণে প্রায়ই লোকই কর্মস্থলে অনুপস্তিত থাকে। আর হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বারে বেশিরভাগ লোকদের যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো কোমর ব্যথা। স্বল্পমেয়াদি ব্যথা এক মাসের কম সময় থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রোনিক ব্যথা এক মাসের অধিক সময় থাকে।
গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক জীবনে কখনো না কখনো এ ব্যথায় আক্রান্ত হয়। সাধারণত দেখা যায় শুরু থেকে কোমরের ব্যথা নির্মূল করতে না পারলে রোগীকে ভবিষ্যতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। মেরুদণ্ডের নিচের হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্কের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনের কারণে এ ব্যথার সূত্রপাত হয়। সাধারণত এ পরিবর্তন ৩০ বছর বয়স থেকে শুরু হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগের উপসর্গও বাড়তে থাকে। প্রথমে কোমরে অল্প ব্যথা থাকলেও ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকে। অনেক সময় হয়তো রোগী হাঁটতেই পারে না। ব্যথা কখনো কখনো কোমর থেকে পায়ে ছড়িয়ে পড়ে। পায়ে ঝিনঝিন ধরে থাকে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পা ফেলতে সমস্যা হতে পারে। পা অবশ ও ভারী হয়ে যায়। পায়ের শক্তি কমে যাওয়া। মাংসপেশি মাঝেমধ্যে সংকুচিত হয়ে যায়। উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ৯০% রোগী দুই মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। শুধু চিকিৎসক নয় কিছু কিছু উপরোক্ত সিনড্রোম বা উপলব্দি অনুভূত হলে কোমরের ব্যথা উপশমে নিজে নিজে নিম্নোক্ত চর্চাগুলো করলে প্রাথমিকভাবে কোমর ব্যথা উপশম করা যায়।
প্রাথমিক প্রতিরোধে করণীয়:
- নিচ থেকে বা মাটি থেকে কিছু তুলতে হলে না ঝুঁকে হাঁটু ভাঁজ করে বসুন ও তারপর তুলুন।
- চেয়ারে বসার সময় কোমর সোজা রেখে বসুন। এ জন্য দু-একটি ছোট কুশন কোমরের নিচের অংশে রেখে বসতে পারেন। এতে কোমর সোজা থাকবে। দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকবেন না। হেঁটে আসুন কিছু সময়ের জন্য বা দাঁড়িয়েও থাকতে পারেন। চেয়ার টেবিল থেকে বেশি দূরে রাখবেন না। সামনে ঝুঁকে কাজ করবেন না। কোমরের পেছনে সাপোর্ট দিন। এমনভাবে বসুন, যেন হাঁটু ও ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে।
- নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত চেয়ার বাদ দিন। চেয়ারে বসলে পা সামান্য উঁচুতে রাখুন।
- ঘাড়ে ভারী কিছু উঠাবেন না। ভারী জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখুন। পিঠে ভারী কিছু বহন করতে হলে সামনে ঝুঁকে বহন করুন।
- ৩০ মিনিটের বেশি একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না। হাঁটু না ভেঙে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না। দীর্ঘ সময় হাঁটতে হলে উঁচু হিল পরবেন না। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিন।
- গাড়ি চালানোর সময় স্টিয়ারিং হুইলে সোজা হয়ে বসুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
- নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা হাঁটুন।
- কাটা, রান্না, মসলা পেষা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা, ঝাঁট দেয়া বা নলকূপ চাপার সময় মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় এবং কোমর সোজা রাখুন।
- কোমরের ব্যথায় ভুগলে বিছানা থেকে ওঠার সময় সতর্ক থাকুন। চিত হয়ে শুয়ে প্রথমে হাঁটু ভাঁজ করুন। এবার ধীরে ধীরে একপাশে কাত হোন। পা দুটি বিছানা থেকে ঝুলিয়ে দিন, কাত হওয়ার দিকে কনুই ও অপর হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসুন।
- দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করবেন না। দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেন বা গাড়িতে বসে থাকলে ঝাঁকুনিতে কোমর ব্যথা আরও বেড়ে যায়। এ জন্য দীর্ঘ যাত্রাপথের বিরতিতে ট্রেন বা গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি বা হাঁটাহাঁটি করুন।
- শক্ত বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করুন। এতে পুরো শরীর যেমন সাপোর্ট পায়, তেমনি নিচের দিকের স্পাইনগুলোতে চাপ কমে যায়। শক্ত বিছানা বলতে কিন্তু খালি কাঠ নয়, আমরা যে তোশক ব্যবহার করি সেটিই, তবে খুব বেশি নরম যেন না হয়। কাত হয়ে অথবা চিত হয়ে শোবেন কিন্তু উপুড় হয়ে শোবেন না।
ব্যায়াম: কোমর ব্যথার জন্য সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক হলো ব্যায়াম। সামনের দিকে ঝুঁকে কোনো ব্যায়াম করবেন না। এতে ব্যথা আরও বেড়ে যাবে। প্রথমে সহজ ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন। প্রতিদিন অল্প অল্প করে ব্যায়াম করুন। এ ক্ষেত্রে নিচের ব্যায়ামগুলো করা যেতে পারে।
এক(১): উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটি পাশে রেখে দিন। ২-৩ মিনিট বিশ্রাম করুন। এবার হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ আস্তে আস্তে ওপরে তুলুন। এভাবে ২-৩ মিনিট থাকুন। আবার আস্তে আস্তে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন।
দুই(২): উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাতগুলো শরীরের পাশে রেখে দিন। হাতের ওপর ভর না দিয়ে ডান পা সোজা রেখে শ্বাস নিতে নিতে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে তুলুন। যতটুকু পারেন ওপরে তুলে ধরে রাখুন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে মনে মনে ১০ পর্যন্ত গুনুন। শ্বাস নিতে নিতে আস্তে আস্তে নিচে নামান। একইভাবে বাঁ পা দিয়েও করুন। এবার দুই পা একসঙ্গে সোজা করে ওপরে তুলে ১০ পর্যন্ত গুনুন। আস্তে আস্তে নামান। এবার হাতের ওপর ভর না দিয়ে দুই পা ও কোমরের ওপরের অংশ একসঙ্গে ধীরে ধীরে ওপরের দিকে তুলুন। ১০ সেকেন্ড ধরে রেখে ধীরে ধীরে নিচে নামান। এভাবে পাঁচবার করে দিনে তিনবার করুন। যদি ব্যথা অনূভুত বেশি হয় একজন অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ কিংবা একজন ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের কাছে যাবে।
কারণ সমূহ:
১) পেশী, হাড়, জোড়া, লিগামেন্ট, জোড়ার আবরণ, ডিস্ক (দুই কশেরুকার মাঝখানে থাকে) ও স্নায়ুর রোগ বা ইনজুরি।
২) বুক, পেট ও তলপেটের মধ্যকার বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যার জন্য কোমর ব্যথা হয়। একে রেফার্ড পেইন বলে।
৩) হারনিয়াটেড ডিস্ক নার্ভকে ইরিটেশন করে। ২০ বৎসরের ঊর্ধ্বে এক-তৃতীয়াংশ লোকের হারনিয়াটেড ডিস্ক থাকে। ৩% লোকের নার্ভ ইরিটেশনের জন্য ব্যথা হয়।
৪) পেশাগত কারণে দীর্ঘক্ষণ বসার ভঙ্গিমা ঠিকমতো না হলে।
৫) ছাত্রছাত্রীর চেয়ারে বসার ভঙ্গিমা ঠিকমতো না হলে।
৬) ড্রাইভিং করার সময় সঠিকভাবে না বসলে।
৭) উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়লে।
৮) স্পোনডাইলোসিস (হাড়ের ক্ষয় ও বৃদ্ধি)।
৯) স্পোনডাইলোইটিস (হাড়ের প্রদাহ)।
১০) স্পোনডাইলিসথেসিস (কশেরুকার স্থানচ্যুতি)।
১১) স্পাইনাল ক্যানাল সরু হওয়া।
১২) হাড় ও তরুণাস্থির প্রদাহ এবং ক্ষয়।
১৩) হাড়ের ক্ষয় ও ভঙ্গুরতা।
১৪) হাড় নরম ও বাঁকা হওয়া।
১৫) অর্থাইটিস।
১৬) ফাইব্রোমায়ালজিয়া।
১৭) হঠাৎ করে হাঁচি, কাশি দিয়েছেন বা প্রস্রাব-পায়খানার জন্য স্ট্রেইন করেছেন।
১৮) সামনে ঝুঁকে বা পার্শ্বে কাত হয়ে কিছু তুলতে চেষ্টা করেছেন।
১৯) হাড়ের ইনফেকশন।
২০) ডিস্কাইটিস (ডিস্কের প্রদাহ)।
২১) হাড় ও স্নায়ুর টিউমার।
২২) কোনো কারণে অতিরিক্ত চিন্তাগ্রস্ত হলে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন:
১) সব সময় ধরে বা জমে (স্টিফনেস) আছে-এই ধরনের ব্যথা।
২) ভারী ওজন তোলা বা অতিরিক্ত কাজের পর তীক্ষ্ণ ব্যথা।
৩) ক্রোনিক বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা হলে।
৪) অনেকক্ষণ বসা বা দাঁড়ানো অবস্থায় ব্যথা হলে।
৫) কোমর থেকে নিতম্ব, উরু, লেগ ও পায়ের আঙ্গুল পর্যস্ত ব্যথা বিস্তৃত হলে।
৬) লেগ বা পায়ে দুর্বলতা বা অবশ অবশ ভাব এবং টিংগ্লিং সেনসেশন হলে।
৭) কোমর ব্যথা কয়েকদিনের মধ্যে না সারলে।
৮) রাতে বেশি ব্যথা হলে বা ব্যথার জন্য ঘুম ভেঙে গেলে।
৯) হাঁচি, কাশি দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বেড়ে যায়।
১০) প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে।
১১) কোমর ব্যথার সঙ্গে প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া থাকলে বা দুর্গন্ধ প্রস্রাব হলে। ব্যথার সঙ্গে জ্বর, ঘাম, শীত শীত ভাব বা শরীর কাঁপানো ইত্যাদি থাকলে।
১৩) শোয়া অবস্থায় বা শোয়া থেকে ওঠার সময় ব্যথা হলে।
১৪) পায়ের গোড়ালি বা পায়ের পাতা দিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হয়।
১৫) অনেকক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা হাঁটা যায় না।
১৬) অন্য কোনো অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দিলে।