জি এম কাদের, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক ও শামীম হায়দার পাটোয়ারী দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন ঘিরে উত্তেজনার মধ্যেই সোমবার তিন জ্যেষ্ঠ নেতাকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দিলেন জাতীয় পাটির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তাঁরা হলেন জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক (চুন্নু)। সেই সঙ্গে মুজিবুল হককে বাদ দিয়ে আরেক কো–চেয়ারম্যান শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব নিযুক্ত করেছেন তিনি। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে মোট ১১ জন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এটাকে জি এম কাদেরের ‘ছাঁটাই রাজনীতি’ বলে আখ্যা দিচ্ছে দলের নেতাদের একটা অংশ।
অব্যাহতি দেওয়া তিন নেতার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও তিনজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, চেয়ারম্যান জি এম কাদের জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারার যে ক্ষমতাবলে তাঁদের অব্যাহতি দিয়েছেন, তাঁরা সেটি চ্যালেঞ্জ করবেন, গঠনতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী ধারার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন। তাঁরা মনে করেন, চেয়ারম্যানের এই অব্যাহতি আদেশ ও মহাসচিব নিয়োগপ্রক্রিয়া অগণতান্ত্রিক, গঠনতন্ত্রের লঙ্ঘন এবং এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে মহাসচিব মো. মুজিবুল হককে অব্যাহতি এবং শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছেন। এর পরপরই শামীম হায়দার পাটোয়ারী চেয়ারম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি দলকে সংগঠিত করতে নেতা-কর্মীসহ সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।
কিছু সময় পর দলের আরেক বিজ্ঞপ্তিতে গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। তবে এই তিন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে গত ২৫ জুন দলের জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মতবিনিময় সভায় দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবির পাশাপাশি এ বিষয়ে ২৮ জুন প্রেসিডিয়াম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের উল্লেখ করা হয়।
রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এই দলটা করি। ৩৫টি মামলা খেয়েছি, জেল খেটেছি, তবু দল ছাড়িনি। আমরা বলেছি, আপনিই নেতৃত্বে থাকুন। ২০/১/ক ধারাটি সংশোধন করে দলে গণতান্ত্রিক চর্চা ও যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। উল্টো আমাদের অব্যাহতি দিলেন। এ ধরনের নীতিনৈতিকতা–বিবর্জিত দল দেশে মনে হয় আর একটিও নেই।’
জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, এ ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ন্যূনতম কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দলের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ (বর্তমানে স্থগিত) ঘোষণা করার পর উচ্চপর্যায়ের কোনো নেতাকে চেয়ারম্যান অব্যাহতি দিতে পারেন না। কারণ, অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুজন নেতা ইতিমধ্যে সম্মেলনে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। ফলে চেয়ারম্যান তার আগেই তিন নেতাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরাতে অব্যাহতি দিয়েছেন কি না, সে প্রশ্নটিও সামনে আসছে।
মূলত দলের প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ জুন সম্মেলন না করে স্থগিত করা, দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা সংশোধনের দাবি ঘিরে এবার জাতীয় পার্টিতে মতবিরোধ দেখা দেয়। দলের তিন জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হক চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের ধারাটি সংশোধনের দাবি জানান। এটাকে জি এম কাদের ও তাঁর সমর্থক নেতারা দলের চেয়ারম্যানকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন।
জি এম কাদেরসহ তাঁর সমর্থক নেতারা মনে করেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হকসহ কিছু নেতা রয়েছেন, যাঁরা সব সময় ক্ষমতাসীনদের থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলকে ব্যবহার করেন। এবারও এই নেতারা একই রকম তৎপরতা শুরু করেছেন। সে জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই তিন জ্যেষ্ঠ নেতার আগে গত এক সপ্তাহে আরও আটজন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা আল মাহমুদ, নাজমা আকতার, নাছির ইউ মাহমুদ, জসিমউদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর রহমান খান, জহিরুল ইসলাম জহির ও সোলায়মান আলম শেঠ এবং কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক (২) এম এ রাজ্জাক খান।
অবশ্য দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত ছিল, যাঁদের মাসিক চাঁদা এক বছর বকেয়া থাকবে, তাঁদের পদ আপনা–আপনি চলে যাবে। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে এই সাতজন বাদ পড়েছেন।
অবশ্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বিগত প্রেসিডিয়াম সভায় চেয়ারম্যানের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকে জবাবদিহি চেয়েছেন। সেটাকে এড়াতেই তিনি এ পদক্ষেপগুলো (অব্যাহতি) নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দলে গণতন্ত্র চাই, সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে দল পরিচালনা চাই। সে জন্য ২০–এর (ক) ধারাটি বদলাতে হবে। কারণ, এটি অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। জি এম কাদের সেটি বদলাতে চান না।’
অব্যাহতি পাওয়ার কিছুক্ষণ আগে দুই জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার বর্তমান মহাসচিব মো. মুজিবুল হককে বাদ দিয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব পদে নিয়োগের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তাঁরা এই নিয়োগকে চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, এটি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ, যা পার্টির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুজিবুল হকই জাতীয় পার্টির বৈধ ও সম্মানিত মহাসচিব।
এই দুই নেতা বিবৃতিতে আরও বলেন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইতিমধ্যে জাতীয় কাউন্সিল ঘোষিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো প্রকার নিয়োগ, অব্যাহতি বা বহিষ্কার সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ। তাঁরা বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে ব্যক্তি নয়, গঠনতন্ত্র ও আদর্শে পরিচালিত হতে হবে। দলে গণতন্ত্র, শৃঙ্খলা ও সম্মিলিত নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনাই এখন সময়ের দাবি।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদেরা মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। জি এম কাদেরের অনুসারীরা জানান, তাঁরাও পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরবেন।