ডিজিটাল মোবাইল মাধ্যমে প্রতারণার গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করেন ই-অরেঞ্জের সোহেল

জনতার কণ্ঠ রিপোর্ট: রাজধানীর বনানী থানার বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ডিজিটাল প্রতারণার মামলায় সোহেল, তাঁর বোন সোনিয়া মেহজাবিনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে সিআইডি। চলতি মাসের শুরুর দিকে আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হাবিবুর রহমান।

ই-অরেঞ্জ নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে কম দামে পণ্য বিক্রির ফাঁদে ফেলে গ্রাহকের এগারো শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সোনিয়ার বিরুদ্ধে। পরে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে আসে, ই-অরেঞ্জের নেপথ্যে রয়েছেন সোনিয়ার ভাই সোহেল।

ক্রয়াদেশ দিয়ে পণ্য না পেয়ে প্রতারিত গ্রাহকেরা একের পর এক মামলা করেন। প্রতারণায় সোহেলের সম্পৃক্ততা সামনে এলে তিনি গা ঢাকা দেন। পরে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতে আটক হন। তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ভারতের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, ‘ভারতে আটক সোহেলকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে তদন্তে যেহেতু তাঁর অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, সে জন্য অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ।’

সোহেলের বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ পাচারসহ একাধিক অভিযোগে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান থানায় হওয়া ডিজিটাল প্রতারণার মামলায় সিআইডি অভিযোগপত্র দিয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সোহেল, তাঁর বোন সোনিয়াসহ মোট সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ই-অরেঞ্জের নামে তাঁরা অনলাইনে পণ্য বিক্রির লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অনেক গ্রাহক পণ্য কেনার ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পণ্য না দিয়ে গ্রাহকদের দিনের পর দিন ঘোরান। তাঁরা গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেন। তাঁদের টাকা আত্মসাৎ করেন।’

অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন—সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, অংশীদার বিথী আক্তার, সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আলম, কর্মকর্তা আমানুল্লাহ ও কাউসার আহমেদ। সোনিয়া, মাসুকুরসহ তিনজন বর্তমানে কারাগারে আছেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সোহেল মূলত তাঁর বোনকে সামনে রেখে ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে প্রতারণা করছিলেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মামলাটির বাদী বি এম সুলতান। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেলে লেখাপড়া করেন। ই-অরেঞ্জের ফেসবুক পেজে তিনি লোভনীয় মূল্যে মোটরসাইকেল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখেন। এই বিজ্ঞাপন দেখে তিনি গত বছরের ১৪ জুন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় একটি মোটরসাইকেল কেনার ক্রয়াদেশ দেন। টাকা নিয়ে সুলতানকে আর মোটরসাইকেল বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আসামি সোহেল রানা ই-অরেঞ্জের একজন পরিচালক। তিনিসহ অন্যরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণায় জড়িত।

প্রতারণার আরেকটি মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ‘ই-অরেঞ্জ শপ লিমিটেড’ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান যৌথ মূলধন কোম্পানি ও নিবন্ধন পরিদপ্তর ফার্ম থেকে নিবন্ধন নেয়নি। পরিদপ্তরের কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে ই-অরেঞ্জের নিবন্ধন সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ই-অরেঞ্জ শপের অ্যাপসের তথ্য পর্যালোচনা করে সিআইডি আদালতকে বলেছে, ৩৭ জন গ্রাহকের ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিকেরা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, সোনিয়া ও তাঁর স্বামী মাসুকুর ২০১৮ সালে ই-কমার্স ব্যবসার পরিকল্পনা করেন। মাসুকুরের সহযোগিতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ই-অরেঞ্জের নামে দুটি ট্রেড লাইসেন্স নেন সোনিয়া। নাজমুল আলম নামের এক ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সোনিয়া একপর্যায়ে বিথী আক্তার নামের এক নারীর নামে মালিকানা হস্তান্তর করেন। মালিকানা বদলের কাগজপত্রে বিথীর প্রকৃত ঠিকানা দেওয়া হয়নি, যা পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণার অংশ। সোহেল ও সোনিয়ার ঘনিষ্ঠ এই বিথী।
দুই হিসাবে আছে মাত্র ৩ কোটি তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ই-অরেঞ্জ শপের দুটি ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পায় পুলিশ। গত বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত এই দুই ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা।

দুটির মধ্যে একটি ব্যাংক হিসাবে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তুলে নেওয়া হয় ৬২০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

আরেকটি ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা পড়ে ৩৯১ কোটি টাকা। তুলে নেওয়া হয় ৩৮৮ কোটি টাকা।

অর্থ পাচারের মামলা সোহেলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গত বছরের ৫ অক্টোবর মামলা করে সিআইডি।

এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছর সোহেলের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা করে।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান বলছে, সোহেল নিজের পরিচয় গোপন করে ই-অরেঞ্জ চালু করেন। তাঁর ছয়টি ব্যাংকের ৩১টি হিসাবে জমা করা হয় ২৮ কোটি টাকা। পরে সেই টাকা তুলে তিনি আত্মসাৎ করেন।

ঢাকায় সোহেলের একাধিক ফ্ল্যাট থাকার তথ্য জানিয়েছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *