ঢাকায় বাড়ি-ফ্ল্যাট সব আছে পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ারের

চাকরিজীবন ২২ বছর। এর ১২ বছরই অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ঢাকায় কাটিয়েছেন। সাড়ে চার বছর মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার; ছিলেন দিনাজপুরের এসপি। অভিযোগ উঠেছে, অনিয়ম করে আনোয়ার দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। ২০১৮ সালে রাতের ভোটে দায়িত্ব পালনের অভিযোগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ওএসডি করে সরকার।

রাজধানীর বনশ্রীতে পাশাপাশি প্লটে আনোয়ারের দুটি সাততলা বাড়ির তথ্য পেয়েছে সমকাল। যদিও ‘এসপি বাড়ি’ নামে পরিচিত এ সম্পদ তিনি করেছেন স্ত্রী খাদিজা ফেরদৌসের নামে। একই এলাকায় পুলিশ পার্ক ভবনে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন নিজের নামে। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরেও জমি কেনাসহ নানা সম্পদ করেছেন আনোয়ার।

তথ্য দিয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা তিনি যে পর্যায়ের হোন, এ ধরনের সম্পদের মালিক হতে গেলে তা বৈধ আয়ে সম্ভব নয়। রাষ্ট্রকেই তাদের প্রতিহত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান করে তাঁকে (আনোয়ার হোসেন) দ্রুত আইনের আওতায় আনা দরকার।’
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বেতনের টাকায় সংসার চালানোর পর এত সম্পদ গড়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতিরিক্ত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন পৈতৃকভাবে এত সম্পদশালী নন যে, ঢাকায় একাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনবেন!

মাদারীপুরের শিবচরের সাতভাগিয়া গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনোয়ার হোসেনের প্রয়াত বাবা খোরশেদ মোড়ল ছিলেন সাধারণ কৃষক। বসবাস করতেন টিনের ঘরে। সংসার চালাতেই হিমশিম খেতেন। কিন্তু আনোয়ার পুলিশে চাকরি নেওয়ার পর বদলে যায় পরিবারটির ভাগ্য!
সরেজমিন দক্ষিণ বনশ্রীর জে ব্লকের ১২/৩ নম্বর সড়কের ১৭ ও ১৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাশাপাশি সাততলা দুটি বাড়ি পাওয়া যায়। একই নকশায় তৈরি বাড়ি দুটির গ্রাউন্ড ফ্লোর এক। আশপাশের বাড়িতে হোল্ডিং নম্বর লেখা সাইনবোর্ড থাকলেও ‘এসপি বাড়ি’ নামে পরিচিত ভবন দুটিতে নেই।

চোখের সামনে ভবন দুটি হতে দেখেছেন– জে ব্লকের এমন পাঁচ বাসিন্দা জানান, আনোয়ার হোসেন মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার থাকার সময় প্রথমে একটি প্লট কিনে ভবন শুরু করেন। পরে পাশের প্লটটি কিনে ২০২২ সালে দুটি ভবনের কাজ শেষ করেন। ভবনের কাজ দেখতে এসে আনোয়ার আক্ষেপ করতেন– শুরুতে প্লট দুটি একসঙ্গে পেলে রাজউক থেকে বহুতল ভবনের অনুমোদন নিতে পারতেন!

আনোয়ার প্রথমে খিলগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আড়াই কাঠার দলিল করেন ২০১৬ সালের ২১ জুন। পাশের প্লটের দলিল ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। জে ব্লকের বাসিন্দা সেলিম হোসেন বলেন, মতিঝিলের ডিসি থাকাকালে আনোয়ার বাড়ি দুটি করেছেন।

বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের মাথায় পুলিশ পার্ক ভবন। ১৮ তলা ভবনের ১ নম্বর টাওয়ারে ১৩-এ এবং ১৩-বি দুটি ফ্ল্যাট আনোয়ারের। ফ্ল্যাট মালিকের তালিকায় দুটিতে আনোয়ারের নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৪০০ বর্গফুট, মার্বেল করা।

ভবনসংশ্লিষ্ট তিনজন সমকালকে জানান, আনোয়ার হোসেনের ফ্ল্যাট দুটির মূল্য কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা। বর্তমানে ভাড়াটে আছেন। মাঝেমধ্যে তিনি দেখতে আসেন।

মাদারীপুরের শিবচরের উমেদপুর ইউনিয়নের সাতভাগিয়া গ্রামে আনোয়ার হোসেনের প্রতিবেশী পাঁচ ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আনোয়ারের বাবা খোরশেদ মোড়লের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আনোয়ারের ভাই হুমায়ুন মোড়ল বাড়িতে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে তিনি আসেন।

স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু আনোয়ারের। প্রথমে পুলিশের সার্জেন্ট, পরে ২০০৩ সালে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে এএসপি হন। ২০২২ সালে আনোয়ার গ্রামে ৩৮ লাখ টাকায় ৫২ শতাংশ জমি কিনেছেন বলে জানান এক প্রতিবেশী।

অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার সম্পদের সব হিসাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে। চাইলে তদন্ত করে দেখতে পারেন।’

আনোয়ার হোসেন কিশোরগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, এসএসএফসহ বিভিন্ন ইউনিটে এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ডিএমপিতে যোগদান করেন। সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে ট্রাফিক বিভাগ, রমনা বিভাগ ও পিওএমে কর্মরত ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদোন্নতি পেয়ে ২০১১ সালের ১১ জুন থেকে ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত রমনা বিভাগের এডিসি ছিলেন। ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর বদলি হন মতিঝিল বিভাগে। সেখানে ২০১৫ সালের ৪ জুন এসপি হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ওইদিনই মতিঝিল বিভাগে উপকমিশনারের দায়িত্ব নেন। ছিলেন টানা ৪ বছর ২৩ দিন।

আনোয়ার মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার থাকার সময় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হয়, যা রাতের ভোট হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনের আগে ১৪ নভেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নমিনেশন ফরম বিক্রি-জমার সময় মিছিল, ব্যান্ডপার্টি, ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসা নেতাকর্মীর ওপর তাঁর নির্দেশে লাঠিচার্জ করা হয়। এ সময় ৫৯ নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের পুরস্কার হিসেবে পরে আনোয়ার বিপিএম পদক পান।

২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর দিনাজপুরের এসপি হিসেবে যোগ দেন আনোয়ার। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট পুলিশ সদরদপ্তরে বদলি হন। যোগদানের চার দিন পর অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতি পান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আনোয়ার হোসেনকে ওএসডি করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *