বিএনপি ভোট বর্জন করায় আরেকটি ‘একতরফা’ নির্বাচনের সমালোচনা কাঁধে নিয়েই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নতুন এ সরকারের সামনে এখন নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগুতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নানামুখী চাপে থাকা অর্থনীতির সংকট মোকাবেলা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি
এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ ও ডলার সংকট মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা নাজুক সময় পার করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে পেশাজীবীদের সবার মধ্যেই একটা ঐক্যমত্য আছে।
তিনি বলেন, ‘সকলেই মনে করেন মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণটাই হলো মূল চ্যালেঞ্জ এই মুহূর্তে। কিন্তু এর সাথে সাথে যেটা দেখা দিয়েছে যে সরকারের কর আহরণের পরিস্থিতি ভালো না। একইসাথে ব্যক্তিখাতে যেসব বিনিয়োগ আছে, সেগুলোর জন্য অর্থায়ন করা, বৈদেশিক মুদ্রা দেয়া এগুলোতে সমস্যা হচ্ছে। এসব কিছু মিলিয়ে আমাদের যে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য সেটার ওপরে বড় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। টাকার অবনমন ঘটছে। টাকার মূল্যমানকে স্থিতিশীল করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দ্রুততম সময়ে শপথ ও মন্ত্রিসভা গঠন করে আবারো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সরকারকে এবার শুরু থেকেই দ্রব্যমূল্য কমানো, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি এবং রিজার্ভ সংকট সমাধানে তৎপর হতে হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
সরকারের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যা কিছু প্রয়োজন তাই করবে নতুন সরকার।
বর্তমান সংসদের একজন প্রভাবশালী সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সালমান এফ রহমান।
বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা।
‘অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটা হলো সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। সেটা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের যা যা কিছু করার আমরা করবো। যেগুলো সংস্কার করতে হবে সেগুলোও আমরা করবো,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে যে চ্যালেঞ্জটা আছে। সেটা কিন্তু কিছুটা আমরা দেখছি ভালো দিকে যাচ্ছে। কমোডিটির দাম কমে আসতেছে। জ্বালানির দামও কিছুটা কমেছে। আমরা আশাবাদী, যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন যদি আমরা ঠিকমতো করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের অর্থনীতি যে আগের যে জায়গায় ছিল সেখানে আমরা নিয়ে আসতে পারবো।’
তবে সালমান এফ রহমান প্রয়োজনীয় সংস্কার করার ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও কবে কীভাবে হবে সেটি দেখার বিষয়। আর নতুন সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের।
সংশয়ের কারণ নিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি হলো সেটার মধ্যে দিয়ে সরকার কি এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে বেরোতে পারবে কিনা, যেটার ভেতর দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে পারবে? কারণ যে সমস্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ছিল যাদের কারণে আগে সংস্কার করা যায়নি তাদেরকেই এই নতুন সরকার মোকাবেলা করার শক্তি নিয়ে বের হয়েছে কিনা এইটাই দেখার বিষয়।’
রাজনৈতিক সংকট
নতুন সরকারের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন হবে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। নির্বাচন হয়ে গেলেও দেশে রাজনীতির সংকট সমাধান হয়নি। রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলকেও মোকাবেলা করতে হবে নতুন সরকারকে।
সামনে রাজনৈতিক বিরোধীরা মাঠে কী ধরনের আন্দোলন করে এবং পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটি নিয়ে কারো কারো মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। অর্থনীতির সংকট পুঁজি করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে কিনা সেটা নিয়েও দুর্ভাবনা আছে অনেকের মধ্যে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, রাজপথে তাদের মোকাবেলা করাই সরকারের জন্য রাজনীতির চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করতে চায়, যারা বাংলাদেশের উন্নয়নকে ধ্বংস করতে চায় এটাই চ্যালেঞ্জ এবং আমি শিওর ইনশাআল্লাহ নতুন সরকার এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।’
এদিকে, শুধু রাজপথে বিরোধী দল মোকাবেলাই যথেষ্ট নয় এই মেয়াদে। কারণ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে একটা বিভেদ তৈরি হয়েছে বলেই মনে হয়েছে।
এই বিভেদ স্থায়ী হতে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। নির্বাচনের পর বিভিন্ন আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও সংঘাত ও সহিংস হামলা হতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন এ সমস্যা সাময়িক এবং দল এটি সামাল দিতে পারবে।
তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক অভিজ্ঞ। ওনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা সেটি দিয়ে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখবেন। ৪৩ বছর রাখছেন, আগামী দিনেও রাখবেন।’
এবার সংসদে আওয়ামী লীগ বিরোধী তেমন কেউই থাকছে না। তাই সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্তের যথাযথ সমালোচনা অথবা সরকারকে চাপ সৃষ্টির মতো কোনো বিরোধিতা হবে না বলেই ধারণা করছেন অনেকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনের পর রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ইমেজ নিয়ে একটা সংকট থেকে যাচ্ছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এখানে রাজনীতি থাকছে না এবং সংসদে যারা বসবেন তাদের মধ্যে সত্যিকারের রাজনীতিবিদের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন।’
তিনি বলেন, ‘এখানে অন্য কোনো দলের আসলে অস্তিত্বই নাই। এরকম একটি দলবিহীন ব্যবস্থা, অথচ আমরা বলছি বহুদলীয় গণতন্ত্র। এই জিনিসটা আমি বলবো যে একটা তামাশার মতো মনে হয়। তো এই তামাশা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে কিনা সরকার এটা হলো সবচাইতে বড় কথা।’
সরকারের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখি না। চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। তারা তাদের গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে পা বাড়াবে কিনা- সেইটাই হচ্ছে তাদের চ্যালেঞ্জ।’
‘নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বলেছেন, যদি কোনো ভুল-ত্রুটি করে থাকি সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে- তো উনি সেটা শোধরানের কী প্রক্রিয়া নেবেন সেটা আমরা দেখবো। পরিবর্তনটা কী আসে সেটাই কিন্তু দেখার বিষয়,’ বলেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
সূত্র : বিবিসি