নারায়ণগঞ্জে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন শামীম ওসমান

নিজস্ব প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় নারায়ণগঞ্জে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সর্বমহলেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতো। যে কেউ তার মতের বাইরে গেলেই তাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকির শিকার হতে হতো। নিজ দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তার হয়রানি থেকে মুক্তি পেতেন না।

শামীম ওসমান প্রায় সময়ই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই অহংকার করে নিজের অস্ত্রবাজিসহ নানা অপকর্মের তুলে ধরতেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন মহলকে তার এসকল অপকর্মকে হাসিমুখে স্বীকার করে নিতে হতো। বিভিন্নভাবে তিনি নিজেকে একজন গডফাদার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে তুলেন। এই গডফাদারের তকমাকে বেশ উপভোগ করতেন তিনি।

যেভাবে গডফাদারের যাত্রা শুরু : ২০০০ সালে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজে জাহানারা ইমামের নামে একটি ভবন উদ্বোধনের পরই বদলে যায় নারায়ণগঞ্জের চিত্র। এর পরেই দ্রুত সব কিছু পাল্টে যায়। আর সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন এমপি শামীম ওসমান। তার দাবি ছিল সেদিনের অনুষ্ঠানের পরেই অনেক কিছুতে পরির্বতন এসেছিল। নারায়ণগঞ্জ বদলে গিয়েছিল। নতুন এক অধ্যায়ের সূচনার কারণেই পরবর্তীতে ‘গডফাদার’ উপাধি দেওয়া হয় তাকে।

প্রতিরাতে তওবা করে ঘুমাতে যান শামীম ওসমান : স্থানীয়রা জানান, ২০০০ সালের ১৬ এপ্রিল সরকারি তোলারাম কলেজে জাহানারা ইমাম নামের একটি ভবন নির্মাণের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে মুক্তমঞ্চের সমাবেশ থেকে রাজাকার, স্বাধীনতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়। সেদিন সমাবেশ শেষে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে নারায়ণগঞ্জে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। এরপরেই মূলত ওই এলাকার নামকরণ হয় সাইনবোর্ড। ওই সমাবেশের তিনদিন পর মুন্সিগঞ্জে একটি কর্মসূচি ছিল মতিউর রহমান নিজামীর। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি নিজামী।

এছাড়া ওই বছরেই নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় প্রতীকী বিচারে সাঈদী, গোলাম আযম ও নিজামীর ফাঁসি দেওয়া হয় প্রতীকীভাবেই। এ নিয়ে একাধিকবার শামীম ওসমান বলেছেন, প্রতিটি ক্রান্তি সময়ে নারায়ণগঞ্জ থেকেই ঘণ্টা বাজিয়েছি। জাহানারা ইমাম ভবন করে ঘণ্টা বাজিয়েছিলাম। গোলাম আযমকে নারায়ণগঞ্জের মাঠে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম। সে কারণে গোলাম আযম আমিরগিরি ছেড়ে দেয়। আমি জামায়াত ও গোলাম আযমকে নিষিদ্ধ করেছিলাম। জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, জিয়াউর রহমানের গাড়ি আটকে দেওয়া, খালেদা জিয়ার লংমার্চ আটকে দেওয়ার কারণেই আমাকে গডফাদার উপাধি দেওয়া হয়। এসব কারণে আমি গডফাদার হলাম। জামায়াত-বিএনপি আর কিছু মিডিয়া আমাকে গডফাদার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।

অস্ত্রবাজিতে নিজেরই স্বীকারোক্তি : ২০২০ সালের ১ মার্চ পুলিশ লাইন্সে জেলা পুলিশের আয়োজনে ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২০’ আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘২০০১ সালের আগে পুরো জেলা পুলিশের ফোর্সের কাছে যত অস্ত্র ছিল, আমার কাছে এর চেয়ে বেশি অস্ত্র ছিল। মিথ্যা কথা বলে লাভ নেই। কিন্তু আজকে আমার গাড়িতেও অস্ত্র আছে কি না, আমি জানি না।’ পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলের বেশ টনক নড়েছিল।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গত ১৯ জুলাই বিকেলে শহরের চাষাঢ়া বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন। আর ওই মিছিলে শামীম ওসমান ও তার কয়েক শতাধিক অনুসারী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কে শহরের ২ নম্বর রেলগেইট এলাকার দিকে ধাওয়া দিয়েছিলেন।

সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গত ১৯ জুলাই বিকেলে শহরের চাষাঢ়া বঙ্গবন্ধু সড়কে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করেন। আর ওই মিছিলে শামীম ওসমান ও তার কয়েক শতাধিক অনুসারী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কে শহরের ২ নম্বর রেলগেইট এলাকার দিকে ধাওয়া দিয়েছিলেন।

সেখানে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ (টিটু) গুলি ছোড়েন। শামীম ওসমানের আত্মীয় (অয়ন ওসমানের শ্বশুর) ফয়েজ উদ্দিন (লাভলু), তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ও শীতল পরিবহনের বাসের পরিচালক অনুপ কুমার সাহা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলামকে দেখা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে শোনা গিয়েছিল এই অস্ত্রের মহড়ার কথা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে শামীম ওসমান গর্ব করে বলেছেন।

ইবাদত নিয়ে লাগামহীন বক্তব্য : ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের হুঁশিয়ারি দেওয়া এক শ্রেণির মাওলানাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাদেরকে আপনারা ইসলাম বুঝান আমরা কুরআন পড়ি না? ২২ বছর ধরে তাহাজ্জুদ ছাড়ি নাই। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ রাকাত নফল নামাজ বেশি পড়ি আল্লাহর রহমতে। দুবেলা কুরআন শরিফ পড়ি। ধর্ম সবার। ধর্মের জবাব আল্লাহর কাছে দেব; আর কারও কাছে না। কারও কাছ থেকে লাইসেন্স দিতে হবে আমার? আমি মুসলমান, আমি মুসলমান না। আপনারা লাইসেন্স দেবেন আমাদের? আল্লাহ আপনাদের হেদায়েত করুক।’ তার এই বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জজুড়ে বেশ আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *