বিএনপি-জামায়াত বাহাস কিনারা কোথায়

অর্থাৎ লন্ডন বৈঠকের পর যে প্রক্রিয়ায় যৌথ বিবৃতি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা ক্ষুব্ধ এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে, যার প্রতীকী কারণ হিসেবে গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকটি বয়কট করেছে দলটি। তবে ওইদিনই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে ফোন করে কথা বলেছেন। অবশ্য গতকালের বৈঠকে অংশ নেয় জামায়াতে ইসলামী। বৈঠকের ফাঁকে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও এনসিপির শীর্ষ নেতারা একসঙ্গে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করেন। নেতাদের হাত ধরে থাকার একটি ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তবে সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমে পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছি। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব আমাদের কাছে সমান। আমরা মনে করছি, ঐকমত্য কমিশন নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখছে। সংস্কার বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষক বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত বিভক্তি নয়, পরস্পরকে সহযোগিতা করা। যেমনটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে তারা করেছেন।

জামায়াতের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ও পেছনের গল্প চার দিনের সরকারি সফরে গত ৯ জুন সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্যে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনেকটা সরকার পক্ষের আগ্রহেই গত ১৩ জুন (শুক্রবার) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে দেড় ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সংস্কার প্রক্রিয়া এবং অতীতে সংঘটিত ছাত্র ও যুবক হত্যা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার এবং দেশের বন্দর, করিডোরসহ নানা প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে এসেছে। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি ঘোষণা করা হয়। এতে আগামী রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিং করেন অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির প্রতিনিধিরা।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গতকালের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠকের জামায়াতের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। বৈঠকের বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের যৌথ সংবাদ সম্মেলন ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এ ঘটনায় দেশের বাকি সব দলই কিছুটা বিব্রত। এখানেই আমাদের আপত্তি ছিল। নিরপেক্ষতা হারালে সরকারপ্রধান ও ঐকমত্য কমিশন বেশিদূর এগোতে পারবে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের আমিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এরপরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী বুধবারের (গতকাল) আলোচনায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ডা. তাহের বলেন, আমরা কখনো সরকারকে ব্যর্থ করতে চাই না। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই।

ভিন্ন কথা বলছে বিএনপি

লন্ডন বৈঠক নিয়ে জামায়াতের ক্ষুব্ধতা প্রসঙ্গে বিএনপি বলছে ভিন্ন কথা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন দূরত্ব হচ্ছিল, তখন প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক হয়েছে। এটি একটি বিরল এবং ঐতিহাসিক ঘটনা। আলোচনার মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে একমত হয়েছেন। এটাই তো রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতার বৈশিষ্ট্য। দুই নেতা একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুলে দিয়েছেন। আর সেই বৈঠকটি অনেকের পছন্দ হয়নি। কারণ নির্বাচন হলেই তাদের বিপদ। এখন নির্বাচন নেই, তাই তাদের গুরুত্ব বেশি। যেই নির্বাচন হয়ে যাবে, দেখবেন জনগণের ভালোবাসার দল ক্ষমতায় আসবে। ফলে তাদের (অপছন্দকারী) গুরুত্ব কতটুকু থাকবে কি থাকবে না, তখন নির্ধারিত হবে। যে কারণে ওরা নারাজ হয়েছে। এমনকি নারাজ হয়ে গতকাল (মঙ্গলবার) একটা বৈঠকে তারা হাজিরও হয়নি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপি এখনো সমর্থন করছে। কারও যদি মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে, সেটা আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। আর নির্বাচন নিয়ে সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করবে বলেই আশা করি।

জামায়াতের সুরেই কয়েকটি দল

লন্ডন বৈঠকের পর গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, ঐকমত্য কমিশন কিংবা সরকারের ভূমিকা কিছু ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে কিংবা কোনো কোনো দলের প্রতি বিশেষ একটা প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এটা হলে এ সংস্কার কিংবা এই সময়ের সর্বজনীন বিষয়টা আমার মনে হয়, হারিয়ে যাবে। তিনি বলেন, এখনো তো নির্বাচন হয়নি, কাজেই ভোট ছাড়া কোন দল বড়, কোন দল ছোট, মেজরিটি পার্টি তো আপনি নির্ধারণ করতে পারেন না। সরকার যদি আগেই কোনো কোনো পার্টির প্রতি একটা দৃষ্টিভঙ্গি রাখে যে এই পার্টি বড়, এই পার্টি মেজরিটি, তাহলে তো অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের কথার গুরুত্ব থাকে না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যে দলগুলোকে আহ্বান করা হয়েছে সে আহ্বান করার ক্ষেত্রে শুধু একটি দল ও তাদের মনা দলগুলোর প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঐকমত্য এবং জুলাই সনদ আমাদের চূড়ান্ত করতে হলে অবশ্যই এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, অন্যান্য স্টেকহোল্ডার, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন শহীদ পরিবারের সদস্যদের মতামতও সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, যে কোনো গঠনমূলক সংলাপ ও আলাপ-আলোচনাকে আমরা স্বাগত জানাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমান ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা। কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বার্তা পৌঁছে দেয়।

বারবার বিভক্তি খারাপ দেখায়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গতকাল কালবেলাকে বলেন, রাজনীতিতে সবাই চায় উইন করতে। কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন করা দলগুলোর উচিত পরস্পরকে সহযোগিতা করা। বারবার বিভক্তি হলে খারাপ দেখায়। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তিনি লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেটি তো জাতীয় ঐক্যের জন্য ভালো হয়েছে। সুতরাং তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক ইস্যুতে কিছু রাজনৈতিক দলের যে অবস্থান, তা অপ্রত্যাশিত। যারা বিভক্তি করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে বিভক্তি রুখতে সবারই উচিত ঐক্যবদ্ধ থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজ করা। যেমনটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা দেখেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *