বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স থেকে শত শত কোটি টাকা উত্তোলন এবং আত্মসাৎ করেছেন বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান

তুফান বিজলী আগুন : আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসন আমলে আওয়ামী লীগের দলীয় নাম পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স থেকে নামে-বেনামে কোম্পানী করে শত-সহস্র কোটি টাকা ভুয়া ঋণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সেই সব বিপুল পরিমাণের অর্থ যথাযথ ব্যবসায়ী কাজে না লাগিয়ে অন্য খাতে স্থানান্তর ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এসআলম গ্রুপ ইতিমধ্যে ৬টি ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে। ইতিপূর্বে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও আত্মসাতের খবর বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
তেমনি চট্টগ্রামের বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর বাগদাদ গ্রুপের বিভিন্ন অঙ্গ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তৈরি করে (নাম সর্বস্ব) ২০টিরও অধিক ব্যাংক থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের ম্যানেজ করে হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করে ব্যবসায়িক কাজে না লাগিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছর আগে সিটি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি মামলাতে কয়েক মাস জেলও খেটেছেন তিনি।
চট্টগ্রামে অর্থঋণ আদালতের বিশেষ নির্দেশনা পাওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সূত্রমতে, সিটি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৭ কোটি ৩ হাজার টাকা ঋণ নেন এমডি ফেরদৌস খান আলমগীর। এ টাকা আদায়ে ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে ব্যাংকটি। যা বর্তমানে সুদে আসলে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ মামলায় ফেরদৌস খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে ১০টির বেশি মামলায় পরোয়ানা জারি ছিল।
আরও জানা গেছে, তার মালিকানাধীন বাগদাদ গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে।
জানা যায়, ব্যক্তিগত খরচ ও ব্যবহারের জন্য সিটি ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নেন বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর। তিনি ২০১৯ সালে খেলাপি হয়ে পড়েন। বর্তমানে তার কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১০ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৬ টাকা। পাওনা আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম অর্খঋণ আদালতে মামলা করেছে। মামলাটি আদালতে চলমান। এছাড়া একই ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে তিনি বাগদাদ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাগদাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ১৭ কোটি টাকা ঋণ নেন। ঋণের পাওনা নিয়মিত পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়েন। এ টাকা আদায়ে ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে ব্যাংকটি। এ মামলায় খেলাপি পাওনা আদায়ে গ্রেপ্তারি পাওনা জারি অর্থঋণ আদালত। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।
গত ৩ নভেম্বর অন্য একটি মামলায় তিনি হাজিরা দিতে আসেন। ওইদিন নগরীর লালদিঘি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। পরে আদালতে পাঠানো হয়। বর্তমানে বাগদাদ এন্টারপ্রাইজের নামে নেয়া ঋণ বর্তমানে সুদে-আসলে ৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে ফনিক্স ফাইন্স্যাসের এক মামলায় ২০১৯ সালের আগস্টে কানাডা থেকে দেশে ফিরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন ফেরদৌস খানের স্ত্রী মেহেরুন নেছা। পরে জামিন নিয়ে আবারও কানাডায় চলে যান। তার বিরুদ্ধেও খেলাপি ঋণের ১৫টি মামলা রয়েছে।
বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর একে একে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক ডজন প্রতিষ্ঠান। পরিবারের সদস্যদের কাউকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কাউকে পরিচালক বানিয়ে মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স, বাগদাদ ট্রেডিং, ফেরদৌস এন্টারপ্রাইজ, বাগদাদ এক্সিম করপোরেশন, বাগদাদ পরিবহন ও বাগদাদ প্রপার্টিজসহ ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। গ্রুপকে বড় দেখিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আকৃষ্ট করেছেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়ে স্ত্রী মেহেরুন নেছা, দুই ভাই তানভীর খান আলমগীর-আজাদ খান আলমগীরসহ পরিবার সদস্যদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়েছেন ঋণ। এক ডজনেরও বেশি ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৭০০ কোটি টাকার বেশি। সম্পদের তুলনায় তাঁদের ঋণ বহুগুণ। এখন আর ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। খেলাপি হয়ে মামলার আসামি সবাই। আদালত দিয়েছেন তাঁদের সাজা।
শুধু ফেরদৌস খান নন, স্ত্রী-সন্তান কিংবা ভাইদের বড় ব্যবসায়ী সাজিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন নুরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, রাইজিং গ্রুপসহ চট্টগ্রামের অন্তত এক ডজন ব্যবসায়ী গ্রুপের উদ্যোক্তারা। এই উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ আছেন কারাগারে, কারও স্বজন আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন বিদেশে, কেউ বা ঠিকানা বদল করে আছেন আত্মগোপনে।
রাইজিং স্টিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থেকে মামলার আসামি হওয়া আসলাম চৌধুরীর ভাই আমজাদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কীভাবে গ্রুপের এমডি হয়েছি তা টেলিফোনে বলতে চাই না। সরাসরি কোনোদিন দেখা হলে বিস্তারিত বলব।’ মামলার আসামি হয়ে আমজাদ চৌধুরী আত্মগোপনে আছেন ঢাকায়। আসলাম চৌধুরীর স্ত্রী আছেন কানাডায়। বক্তব্য জানতে অন্য গ্রুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও কারও ফোন নম্বরে কল দিয়ে কথা বললেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নুরজাহান গ্রুপের : নুরজাহান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ। অল্প সময়ে ২০টি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে পরিবারের সদস্যদের কোনোটিতে চেয়ারম্যান, কোনোটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোনোটিতে করেছেন পরিচালক। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি স্ত্রী মনোয়ারা ওরফে তাসমিন আহমেদ, দুই ভাই টিপু সুলতান ও ফরহাদ মনোয়ার, অন্য দুই স্বজন জসিম উদ্দিন ও ইফতেখার আল-জাবেরের নাম ব্যবহার করেছেন। এ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা আছে এক ডজনেরও বেশি। আছে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও ছিল। এর মধ্যে গ্রেপ্তারও হন রতন ও তাঁর ভাই। বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার পরও শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকায় আসেনি নুরজাহান গ্রুপের নাম। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুবিধা নিয়ে কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতপশিল করেছেন তিনি। কয়েকশ কোটি টাকা এখনও খেলাপি ঋণ আছে নুরজাহান গ্রুপের। গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে অগ্রণী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৭৬৯ কোটি, রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৫৪৪ কোটি টাকা, গ্রুপের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের তিন শাখার ৫০০ কোটি, জনতা ব্যাংক লালদীঘি শাখার ৩২৬ কোটি ও সোনালী ব্যাংকের ১০৬ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মেসার্স জাসমির ভেজিটেবল অয়েলস লিমিটেডের কাছে ৩২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে ২০১৩ সালে আদালতে মামলা করে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির লালদীঘি শাখার দায়ের করা মামলায় ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রায় হয়। এ রায়ে নুরজাহান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ এবং তাঁর ভাই পরিচালক টিপু সুলতান ও ফরহাদ মনোয়ারকে পাঁচ মাসের আটকাদেশ দেন আদালত। চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে এই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২০টি।
ঋণ নিতে স্ত্রীসহ ছয়জনের নাম: ইমাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ব্যাংকের টাকা লুট করেছেন তিনি। এ জন্য মোহাম্মদ আলীসহ ছয়জনকে গত সেপ্টেম্বরে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল চট্টগ্রামের আদালত। মোহাম্মদ আলী তাঁর স্ত্রী জেবুন নাহার, ছেলে আলী ইমামসহ মনির আহম্মদ সওদাগর, ফেরদৌস বেগম ও রিজিয়া বেগমকে নিয়ে ঋণ নিয়েছেন। এই গ্রুপের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৬০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে অর্থঋণ আদালতে। ঋণের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংক মামলা করেছে তাতে গ্রুপটির কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭৯৩ কোটি টাকা পাওনা থাকার তথ্য আছে। এর মধ্যে মোট ৫৫টি মামলায় মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও আছে এক ডজনের বেশি ওয়ারেন্ট। ব্যাংকের দায়ের করা দুটি চেক ডিজঅনার মামলায় এরই মধ্যে আদালত এক বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন মোহাম্মদ আলীকে। তাঁর সন্তানরা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন সে ব্যাপারেও সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে সতর্কও করেছিল আদালত।
তিনি সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, ইসলামি ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক সহ অগণিত ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কোম্পানির নামে-বেনামে এসব অর্থ উত্তোলন করে ব্যবসায়িক কাজে তেমনটা ব্যবহার করেন নাই।
অফিসিয়াল সূত্রে পাওয়া গেছে ফেরদৌস খান আলমগীর কানাডার বেগম পাড়ায় বিলাস বহুল ফ্যাট ও দামি গাড়ী এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ বিভাগ থেকে তথ্যসূত্রে পাওয়া গেছে।
গত আগস্ট মাসে ছাত্র জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, শত শত ছাত্র জনতার নিহত, আহত, পঙ্গুত্ব এবং চূড়ান্ত গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ফেরদৌস খান আলমগীর ভয়ে ভীত হয়ে কিছুদিন নিজেকে গা ঢাকা দিয়ে রেখেছেন।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ঋণ খেলাপী, অর্থ লোপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের উদ্দেশ্যে কড়া সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। যেকোন মূল্যে খেলাপী ঋণকারী ও বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকারিতা করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *