তারকার সঙ্গে তারকার বিয়ে, পার হয়েছে যুগ যুগ—এমন দৃষ্টান্ত আছে
তারকার সঙ্গে তারকার বিয়ে, পার হয়েছে যুগ যুগ—এমন দৃষ্টান্ত আছেকোলাজ বিচ্ছেদ, বিচ্ছেদ আর বিচ্ছেদ—এমন খবর যেমন বিনোদন অঙ্গনে চাউর হয়, তেমনি ব্যতিক্রমও আছে। তারকার সঙ্গে তারকার বিয়ে, পার হয়েছে যুগ যুগ—এমন দৃষ্টান্ত দেশের বিনোদন অঙ্গনে ভূরি ভূরি রয়েছে। তাঁদের মতে, মিল-অমিল পৃথিবীর সব দাম্পত্যে আছে। কেউ মানিয়ে নেয়, কেউ খুব সহসায় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, আপস করার ভাবনাচিন্তা সম্পর্কের দীর্ঘ পথ রচনা করে। যুগ যুগ ধরে যেসব তারকা নিজেদের দাম্পত্য জীবন অটুট রেখেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ এই নীতি মেনেই জীবন পার করছেন। তাই তো সাধারণের কাছে এসব তারকা আদর্শ হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে আশার আলো খোঁজেন। দেশের বিনোদন অঙ্গনের কয়েকজন তারকা জুটিকে নিয়ে এই আয়োজন সৈয়দ হাসান ইমাম-লায়লা হাসান চলচ্চিত্র, নাটক আর গানের শিল্পীদের ঘর ভাঙার খবর এখন হরহামেশাই শোনা যায়। ভাঙনের এই খবর যেমন তাঁদের ভক্তদের কষ্ট দেয়, তেমনি সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসানদের মতো গুণী অভিনয়শিল্পীদের বিবাহিত জীবনের ৫৮ বছর উদ্যাপনের খবরে আবার আনন্দিত করে। গত ৩০ জুন বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের এই দুই গুণীজন বিবাহিত জীবনের ৫৮ বছর পার করছেন। ১৯৬৫ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লায়লা হাসান। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির পরিবারকে লায়লা হাসানের কখনো অচেনা মনে হয়নি। এই পরিবারও বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পীর সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সব সময় সমর্থন জুগিয়ে গেছে।
সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান এক সাক্ষাৎকারে শ্বশুরবাড়ির সবাই লায়লা হাসানের কাজ ভীষণ ভালোবাসত উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার নাচ, আমার নাটক ভীষণ ভালোবাসতেন সবাই। আমার শাশুড়ি তো কক্সবাজারে কাজ থাকলে সেখানেও চলে যেতেন। খুব সকালে ঘুম থেকে আমাকে তুলে সূর্য ওঠা দেখাতেন।’ স্বামী সৈয়দ হাসান ইমামের চেয়ে লায়লা হাসান ১২ বছরের ছোট। তারপরও তাঁদের দুজনের সম্পর্কটা ছিল দারুণ শ্রদ্ধার আর বন্ধুত্বের। বললেন, ‘আমি বয়সে ছোট হলেও ছোটর প্রতি যে আলাদা শ্রদ্ধা দেখানো উচিত, তা তিনি ভীষণভাবে দেখাতেন। পরিবার আর ক্যারিয়ারের কোনো কাজ আলোচনা না করে, তিনিও করেননি, আমিও না। সবকিছু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই করতাম। আমার স্বামী ছিল সবচেয়ে বেশি সাপোর্টিভ। শ্বশুরবাড়ি থেকেও কেউ আমাকে কোনো কাজে বাধা দেয়নি।’
সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল ভিত কী? ‘সমঝোতা ও বিশ্বস্ততা হচ্ছে সম্পর্কের মূল ভিত। দুজন দুজনকে বিশ্বাস করতেই হবে। আমরা কাজের জন্য দেশের বহু জায়গায় গিয়েছি, দেশের বাইরে গিয়েছি। একা আমি গিয়েছি, একা উনিও গিয়েছেন—মনে করেছি, আমার স্বামী আমারই। যত মেয়ের সঙ্গে অভিনয় করুক, উনি আমারই আছেন—এটা সব সময় মনে করতাম। তাঁর কাছ থেকেও আমার কোনো কিছুতে কমতি পাইনি। বিশ্বাস করাটা, বিশ্বস্ততা খুব জরুরি। সংসারজীবনে কথা-কাটাকাটি হবেই। ঝগড়াঝাঁটিও হবেই। মতের অমিল হবেই। তারপরও একটা বোঝাপড়ায় চলে আসব,’ জানালেন লায়লা হাসান।
রামেন্দু মজুমদার-ফেরদৌসী মজুমদার ৫৩ বছরের দাম্পত্য জীবন পার করছেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার। ১৯৬১ সালে একই সঙ্গে দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ফেরদৌসী বাংলায়, রামেন্দু ইংরেজিতে। তরুণ রামেন্দু মজুমদারের ও ফেরদৌসীর আলাপ হয়েছিল মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকে কাজ করতে গিয়ে। পরিচয়ের পর কেমন করে যেন বারবার দেখা হয়ে যেত দুজনের। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরবেন ফেরদৌসী, রিকশা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব পালনে হাজির রামেন্দু। কিন্তু রিকশা আশপাশেই আছে।
ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার সেটি ডাকার কোনো তাড়া অনুভব করতেন না। এটা যে কাছে আসা, পাশে থাকার চেষ্টা, বুঝতে দেরি হয়নি ফেরদৌসীর। ওই সময়ে ধর্মের বেড়াজাল পেরিয়ে একে অন্যের গলায় মালা পরানো সহজ ছিল না। শত বাধা ডিঙিয়ে ১৯৭০ সালের ১৪ মার্চ তাঁরা বিয়ে করেন। পাঁচ দশক পেরিয়ে এখনো দুজন সুখে-দুঃখে পরস্পরের পাশে আছেন। একসঙ্গে এত লম্বা জীবন অতিবাহিত করার রহস্য কী? দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্নে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘কোনো রহস্য নেই। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও বন্ধুত্বের কারণেই আমরা এত দূর আসতে পেরেছি।’ রামেন্দু মজুমদারের ‘কেয়ারিং’ বিষয়টা খুব পছন্দের ফেরদৌসীর। ৫৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে টুকটাক যে রাগারাগি, ঝগড়া হয়নি—তা নয়। তবে সেটা একেবারেই কম। তবে ফেরদৌসী মজুমদার রাগলে চুপচাপ থাকেন রামেন্দু মজুমদার। সংসারের বাজার-সদাই থেকে শুরু করে সবকিছু ফেরদৌসীই সামলান। আর বাইরের, যেমন বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার হিসাব-নিকাশের সব খবর রাখেন রামেন্দু মজুমদার।
রফিকুল আলম-আবিদা সুলতানা
১৯৭৩ সালে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও সাংবাদিক কামাল লোহানী পল্টনে একটি সংগীত সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে রফিকুল আলম গান গাইলেন। সেই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানীই আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন; কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করিয়ে দেন লাকী আখান্দ্। গানের জগতে একসঙ্গে পথ চলতে চলতেই তাঁরা একে অন্যের কাছাকাছি আসেন। ১৯৭৪ সালে তাঁদের প্রেমের সূচনা, ১৯৭৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একই ছাদের নিচে বাস করে দেশের সংগীতপিপাসুদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে যাচ্ছেন। সত্তরের দশক থেকে গানের জগতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন রফিকুল আলম।
১৯৬৭ সালের দিকে রাজশাহী বেতারকেন্দ্রে প্রথম গান করেন; পরবর্তী সময় গানের জন্যই ঢাকায় চলে আসেন। কলেজে পড়ার সময় যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে। আধুনিক গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্যও প্লে-ব্যাক করেছেন তিনি। গানের সূত্রেই শিল্পী আবিদা সুলতানার সঙ্গে পরিচয়। এরপর ১৯৭৫ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন আবিদা সুলতানা ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন প্রসঙ্গে রফিকুল আলম জানান, একটা দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন টিকে থাকার পেছনে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরকে সম্মান এবং একে-অপরের মতামত সহ্য ও গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তিনিই শ্রেষ্ঠ স্বামী, যিনি তাঁর স্ত্রীকে শতভাগ বুঝতে পারেন।’ এই দম্পতির সংসারে রয়েছে একটি পুত্রসন্তান।
ওয়াহিদা মল্লিক জলি ও রহমত আলী দম্পতি রহমত আলী-ওয়াহিদা মল্লিক জলি মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের অভিনয়শিল্পী দম্পতি রহমত আলী ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি। তাঁদের দুজনের বাড়ি রাজশাহীতে। তবে দুজনের পরিচয় এবং কাছাকাছি আসা মূলত ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। ১৯৮৯ সালে দেশে এসে জলি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। রহমত আলী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। টানা ছয় বছর প্রেম করার পর ১৯৯০ সালে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন তাঁরা। রজত আর সহন নামের দুই পুত্রসন্তান তাঁদের। ইতিমধ্যে বিবাহিত জীবনের ৩৩ বছর পার করছেন।
নাঈম-শাবনাজ ‘চাঁদনী’ সিনেমায় বাংলাদেশ পায় শাবনাজ-নাঈম জুটিকে। ১৯৯১ সালের ৪ অক্টোবর মুক্তি পায় ছবিটি। কয়েক বছরের অভিনয়জীবনে ২০টি ছবিতে কাজ করেছেন তাঁরা। এর পর থেকে সিনেমাপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে এই জুটি। অন্যদিকে নায়ক-নায়িকার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার জায়গাটাও পোক্ত হতে থাকে। ‘বিষের বাঁশি’ ছবির সময়ে এসে প্রেমে জড়ান দুজন। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর হঠাৎ বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের পর চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান তাঁরা। এখনো বিনোদন জগতের সফল জুটির কথা বললে তাঁদের নাম প্রথম দিকেই আসে। দাম্পত্য জীবনে সুখী এই জুটির এখন সময় কাটে দুই মেয়ে, সংসার আর ব্যবসা নিয়ে। সংসারের বন্ধন এত দৃঢ়, কী করে হলো? শাবনাজ বলেন, ‘এক একটা বয়সে এক এক রকম করে কেটেছে আমাদের। কখনো খুব ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, কোনো কোনো সময় গেছে অনেক আনন্দে। দুজনে মিলে বাইরে ঘোরাঘুরি করেছি, আনন্দ করেছি। বাচ্চা হওয়ার পরের জীবন আরেক রকম। বহু রাত আমরা না ঘুমিয়ে একসঙ্গে কাটিয়েছি।’
বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় জুটি নাঈম–শাবনাজ বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয়
শাবনাজ-নাঈমের ২৮ বছরের সংসারে প্রতিবারের মান-অভিমানের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩০ মিনিট। রাগারাগি হলে কী করতেন নাঈম? শাবনাজ বলেন, ‘মেয়েরা তো একটুতেই রেগে যায়। এখনো আমার রাগ হলে নাঈম “সরি” বলে। আমি খুবই কম “সরি” বলি। এটা নিয়ে আমার মেয়েরাও বলে, “মা, তোমার দোষ থাকলেও তুমি একদমই সরি বলো না।” যখন নাঈম ও মেয়েরা মিলে ধরে, তখন আমি বাধ্য হয়ে “সরি” বলি। আমি রাগ করলেও নাঈম আগে এসে কথা বলে। নাঈম চায় না, বাসার ভেতর কোনো রাগারাগি থাকুক। রাগ করলে এখনো সে আমাকে ময়না বলে রাগ ভাঙায়।’ কথাগুলো বলতে বলতে সেই সিনেমার ভঙ্গিতেই হাসতে থাকেন শাবনাজ। ‘বিষের বাঁশি’ ছবিতে তাঁর চরিত্রের নাম ছিল ময়না। সেই থেকে আজও তিনি নাঈমের ময়না।