বিশ্বের ইতিহাসের দামি ১০ কলম, সর্বোচ্চ মূল্য ৯৭ কোটি টাকা

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫ সাপ্তাহিক জনতার কণ্ঠ

কলম নিছক লেখার উপকরণ নয়, দীর্ঘদিন ধরে কলমের মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও রুচিশীল কারুশিল্পকে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতা দেখা গেছে। মিসরীয় লেখকদের ব্যবহৃত প্রাচীন নলখাগড়া থেকে শুরু করে ১৯ শতকের ফাউন্টেন পেন পর্যন্ত নানা রূপে বিবর্তিত হয়েছে কলম।

২০ শতকের গোড়ার দিকে মূল্যবান ধাতু ও পাথরে সজ্জিত বিলাসবহুল কলমগুলো মর্যাদা ও শৈল্পিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আর বর্তমান সময়ের কলমগুলোয় সূক্ষ্ম নকশা ও ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা যায়। আন্তর্জাতিক নিলাম প্রতিষ্ঠান সদবির সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুবাই সদবি’স ইন্টারন্যাশনাল রিয়েলটির ওয়েবসাইটে বিশ্বের দামি ১০ কলমের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী দামি কলমগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ফুলগর নকটারনাস

ফুলগর নকটারনাস কলম

ইতালির প্রতিষ্ঠান তিবালদির তৈরি ফুলগর নকটারনাস একটি অনন্য কলম। ফুলগর নকটারনাসের অর্থ ‘রাতের ঝলমলে প্রভা’। ২০২০ সালে সাংহাইয়ে একটি দাতব্য সংস্থার নিলামে কলমটি ৮০ লাখ ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৭ কোটি টাকা) বিক্রি হয়েছিল। ব্যতিক্রমধর্মী এই কলমে ৯৪৫টি কালো রঙের হীরা এবং ১২৩টি চুনি বসানো আছে। আর কলমের নিবটি তৈরি হয়েছে ১৮ ক্যারেটের সোনা দিয়ে। কলমের ১৬টি ক্লিপসহ সামগ্রিক নকশায় ব্যবহৃত উপাদানগুলো অত্যন্ত যত্নসহকারে তৈরি করা। এই কলমের অসাধারণ নকশা, বিরল উপকরণ ও দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি কলমের মর্যাদা ধরে রেখেছে। বিশ্বে শুধু একটি ফুলগর নকটারনাস কলম আছে।

মন্টব্ল্যাঙ্ক তাজমহল লিমিটেড এডিশন

মন্টব্ল্যাঙ্ক তাজমহল লিমিটেড এডিশন

মন্টব্ল্যাঙ্ক তাজমহল লিমিটেড এডিশন কলমটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি কলম। এর মূল্য ২০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা)। মোগল সাম্রাজ্যের সুবর্ণযুগ উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে এই কলম তৈরি করা হয়েছিল। সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি জটিল কারুকাজের কলমটি বিশ্বে মাত্র ১০টি আছে। কলমের মূল অংশটি তৈরি হয়েছে শ্যাম্পেইন রঙের সোনা দিয়ে। এর ওপর হীরা, নীলা পাথর ও মালাকাইট দিয়ে কারুকাজ হয়েছে। কলমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোগল আমলের জমকালো ভাব। কলমের ঢাকনার মাথার অংশটি তাজমহলের গম্বুজের কথা মনে করিয়ে দেয়। আর সামনের অংশে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মোগল কারুকাজ।

মন্টব্ল্যাঙ্ক জোহানেস কেপলার হাই আর্টিস্ট্রি স্টেলা নোভা লিমিটেড এডিশন ওয়ান

মন্টব্ল্যাঙ্ক জোহানেস কেপলার হাই আর্টিস্ট্রি স্টেলা নোভা লিমিটেড এডিশন ওয়ান

কিংবদন্তি জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ জোহানেস কেপলারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্টব্ল্যাঙ্ক জোহানেস কেপলার হাই আর্টিস্ট্রি স্টেলা নোভা লিমিটেড এডিশন ওয়ান নামের কলমটি তৈরি করা হয়। এর দাম ১৫ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা)। রাতের আকাশের অনুপ্রেরণায় কলমটির নকশা করা হয়েছে। এতে ৫ হাজার ২৯৪টি নীলকান্তমণি এবং ৫৭০টি হীরা বসানো আছে। কলমের ঢাকনায় নীলা পাথরগুলো আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে ছায়াপথের অনুকরণে বসানো। ঢাকনার ওপরের অংশে একটি ৬ দশমিক ২ ক্যারেটের হীরার মুকুট বসানো। এটিকে ঘিরে তিনটি সাদা রঙের সোনার বেষ্টনী বসানো আছে যা কেপলারের গ্রহের গতিসংক্রান্ত তিনটি নিয়মকে উপস্থাপন করে। কলমটি যেন অনবদ্য কারুকাজ আর ঐতিহাসিক তাৎপর্যের মিশেল। নিঃসন্দেহে এটি সংগ্রহে রাখার মতো অনবদ্য এক নিদর্শন।

মন্টব্ল্যাঙ্ক বোহেম রয়্যাল পেন

মন্টব্ল্যাঙ্ক বোহেম রয়্যাল পেন

১৮ ক্যারেটের সাদা সোনা এবং ১ হাজার ৪৩০টির বেশি হীরা দিয়ে সজ্জিত একটি অসাধারণ কলম মন্টব্ল্যাঙ্ক বোহেম রয়্যাল। এই কলমের দুটি সংস্করণ আছে। একটি শুধু সাদা হীরা দিয়ে তৈরি আর অপর সংস্করণটি সাদা ও কালো রঙের হীরার মিশ্রণে তৈরি। কলমটি ঐশ্বর্যের প্রতীক। এর নিব খোলা যায় এবং কালি শেষ হয়ে গেলে নতুন করে কালি ভরা যায়। আর এই বৈশিষ্ট্য কলমটিকে ব্যবহারবান্ধব করে তুলেছে। মূল্যবান পাথরগুলো দিয়ে কলমজুড়ে ঢেউয়ের মতো কারুকাজ করা। মন্টব্ল্যাঙ্ক লোগোটি ৩টি সাদা সোনার বলয় এবং ১৯টি হীরা দিয়ে তৈরি। কলমের ক্লিপটি একটি প্যারামাউন্ট-কাট হীরা দিয়ে তৈরি। অসাধারণ নকশা ও দুর্লভ হওয়ায় কলমটি বিশ্বের শীর্ষ দামি কলমগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। এর দাম ১৫ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা)।

দিয়ামান্তে

দিয়ামান্তে কলম

ইতালীয় কোম্পানি অরোরা এই কলম তৈরি করেছে। কলমটিতে বিভিন্ন মূল্যবান জহরত দিয়ে কারুকাজ করা হয়েছে। কলমের ব্যারেলটি কঠিন প্লাটিনাম দিয়ে তৈরি। স্পষ্ট লেখা নিশ্চিত করতে এতে আছে ইরিডিয়ামের প্রলেপযুক্ত সোনার নিব। দিয়ামান্তে কলমের ওপর ৩০ ক্যারেটের বেশি ওজনের ১ হাজার ৯১৯টি ডি বিয়ার্স ক্যাবোচন হীরা দিয়ে কারুকাজ করা হয়েছে। অরোরার প্রতিষ্ঠার বছরকে স্মরণ করে এই ১ হাজার ৯১৯টি হীরা ব্যবহার করা হয়। বাড়তি কালি সংরক্ষণের জন্য কলমটিতে একটি গুপ্ত জায়গা আছে। একেকটি দিয়ামান্তে কলম তৈরি করতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এ কারণে এ ধরনের কলম খুব বেশি একটা উৎপাদন করা হয় না। সাধারণত বছরে মাত্র একটি কলম তৈরি করে কোম্পানিটি। কলমটির দাম ১৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা)।

কাহরান দাশ ১০১০ ডায়মন্ড এডিশন

কাহরান দাশ ১০১০ ডায়মন্ড এডিশন

সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি কাহরান দাশের তৈরি ১০১০ ডায়মন্ড এডিশন কলমটিতে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা হয়েছে। এর দাম ১০ লাখ ২৮ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা)। ১৮ ক্যারেটের কঠিন সাদা সোনা দিয়ে তৈরি এই কলমটিতে ৮৫০টির বেশি হীরা বসানো। কলমের ঢাকনাটি ঘড়ির গিয়ারের দাঁতের মতো। কলমের ক্লিপটি ঘড়ির আকৃতির। এতে কাহরান দাশ কোম্পানির মনোগ্রাম রয়েছে। মূল্যবান পাথর ও শৈল্পিক কুশলতা কলমটিকে দুর্লভ করে তুলেছে।

হ্যাভেন গোল্ড বাই আনিতা তান

দ্য হেভেন গোল্ড বাই আনিতা তান

দ্য হ্যাভেন গোল্ড বাই আনিতা তান কলমটি রুচি ও নৈপুণ্যের এক দারুণ নিদর্শন। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের মাত্র আটটি কলম আছে। এতে বসানো হয়েছে ১ হাজার ৮৮৮টি হীরা, সর্বসাকল্যে যার ওজন ৪৮ ক্যারেট। পাশাপাশি এটিতে ১৬১টি উজ্জ্বল রঙের হীরা আছে, যা অসাধারণ রকম জ্বলজ্বল করে। ২০১০ সালে নকশা করা এই কলম চীনের প্রাচীন রাজ্য তানের ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে শুভ সংখ্যা ৮ ব্যবহার করা হয়েছে। হ্যাভেন গোল্ডের কারুকাজ করা হয়েছে ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে। দুষ্প্রাপ্যতা ও জটিল কারুকাজের কারণে কলমটি সংগ্রাহকদের কাছে খুবই কাঙ্ক্ষিত বস্তু। এর দাম ৯ লাখ ৯৫ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ কোটি ৭ লাখ টাকা)।

মিস্ট্রি মাস্টারপিস

মিস্ট্রি মাস্টারপিস কলম

মিস্ট্রি মাস্টারপিস নামের এই দামি কলম ২০০৬ সালে যৌথভাবে তৈরি করেছে মন্টব্ল্যাঙ্ক ও ভ্যান ক্লিফ অ্যান্ড আরপেলস। এই দুই ব্র্যান্ডের ১০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কলমটি তৈরি করা হয়। ব্যয়বহুল এই কলমের তিনটি সংস্করণ আছে। প্রতিটিতে নীলকান্তমণি, চুনি বা পান্না দিয়ে কারুকাজ করা। মিস্ট্রি মাস্টারপিসের ওপর ৮৪০টি হীরা বসানো, যার মোট ওজন ২০ ক্যারেট। কলমটিতে ভ্যান ক্লিফ ও আর্পেলসের মিস্ট্রি সেটিং কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এই কৌশলের কারণে কলমটির দিকে একঝলক তাকালে ভাসমান পাথরের মতো বিভ্রম হয়। মিস্ট্রি মাস্টারপিস কলম তৈরি হয়েছে মাত্র ৯টি। এর দাম ৭ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা)।

কাহরান দাশ গথিকা পেন

কাহরান দাশ গথিকা পেন

গথিক শিল্প ও স্থাপত্যের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ২০০৬ সালে প্রথম গথিকা কলম তৈরি করে সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি কাহরান দাশ। এ ধরনের কলম তৈরি হয়েছে ১ হাজার ১৪০টি। এর দাম ৪ লাখ ৬ হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ৯২ লাখ টাকার বেশি)। রোডিয়ামের প্রলেপ দেওয়া কলমটিতে গথিক জানালার মতো নকশা করা আছে। তার ওপর আবার রংবেরঙের ফুলের নকশা। বার্সেলোনার রৌপ্যশিল্পীরা কলমটির আকার তৈরি করেছেন আর কাহরান দাশ কোম্পানির দক্ষ কারিগরদের হাতে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে গথিকা কলম। রোডিয়াম ও ১৮-ক্যারেট সোনার মতো মূল্যবান উপকরণ দিয়ে তৈরি অনন্য এই কলম সংগ্রাহকদের কাছে আগ্রহের বস্তু।

মন্তেগ্রাপ্পা ড্রাগন ব্রুস লি সেট

মন্তেগ্রাপ্পা ড্রাগন ব্রুস লি সেট

ইতালির কোম্পানি মন্তেগ্রাপ্পার তৈরি ড্রাগন ব্রুস লি নামের কলম সেটটি কিংবদন্তি মার্শাল আট তারকা ব্রুস লির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এর দাম ২ লাখ ৯০ হাজার ডলার  (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকার বেশি)। এই সেটে আছে একটি ফাউন্টেন পেন, একটি বলপয়েন্ট কলম, একটি ক্রিস্টালের তৈরি কালির পাত্র। মূল্যবান সেলুলয়েড ও ১৮-ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি কলমগুলোয় কালো ও সাদা রঙের হীরা বসানো এবং ড্রাগনের নকশা করা। অসাধারণ এই কলমও শৌখিন সংগ্রাহকদের প্রিয় বস্তু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *