ভালোবাসার এলিয়েন

শায়লা জাবীন
ঐন্দ্রিলা বুঝে উঠতে পারছে না, ছেলেটা আসলে কী চায়…!
ফ্রেন্ডলিস্টে আছে বছরখানেক, বয়সে এক দুই বছরের বড় তার থেকে। কখনো উল্টোপালটা কিছু বলেনি বা পাঠায়নি, ইদানীং মেসেঞ্জারে দু–চারটে গানের লিঙ্ক পাঠায়। তবে কিছু বলে না, গানগুলো সে তার নিজের ওয়ালেও শেয়ার করে, তাহলে আলাদা করে তাকে পাঠাতে হবে কেন? ছেলেটা দেখতে হ্যান্ডসাম প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে, হইহুল্লোড় করে বেড়ানো টাইপ, দিন–দুনিয়ায় কিছু একটা হলেই সেটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বসে, ভাইরাল বিষয় আরও ভাইরাল করে। দুই দিন পরপর নিজের ছবি আপলোড করে, কিছু মেয়ে আবার সস্তা টাইপের গলে যাওয়া কমেন্ট করে সেখানে। মাঝেমধ্যে দু–চারটে কবিতাও পোস্ট করে নিজেকে কিছুটা সাহিত্য অনুরাগী বোঝাতে যদিও ঐন্দ্রিলার সেগুলো বড়শির টোপ ছাড়া বেশি কিছু মনে হয় না। চাকরি-ব্যবসা কিছু একটা করে মনে হয় ঠিক জানে না সে। আজ হঠাৎ বেশ অর্থবোধক একটা গান পাঠিয়েছে…আগেরগুলোরও অর্থ ছিল, কিন্তু সেভাবে না ভাবলেও চলত, আজকের গানটা ভাবাচ্ছে…।
অতনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, ঠোঁটের কিনারার হাসি সুবিস্তৃত হলো, দুই পাটি দাঁত বেরিয়ে গেল খুশিতে! চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছা করছে ইয়াহু…কত মিনিট, কত ঘণ্টা, কত সময় সে অপেক্ষা করছে এই দিনটার জন্য।
এখন তার খুব ভেবেচিন্তে আগাতে হবে, একটু ভুল করলেই বিপদ হয়ে যাবে। অতনু মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে মেসেঞ্জারে আসা টেক্সটার দিকে…, ঐন্দ্রিলা নাম মেয়েটার, কেমন যেন সম্মোহনী করে ফেলার মতো চেহারা এবং চাহনি নিয়ে জন্মেছে সে। অতনুর সঙ্গে ফেসবুকে আছে প্রায় এক বছর, দুজনেই কম বেশি গান গায়, সেই সূত্রে এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড রায়হানের শেয়ার করা পোস্টের কমেন্ট এ প্রথম পরিচয়। ওখানে অতনু এবং ঐন্দ্রিলা দুজনেই বেশ হাসির কমেন্ট করেছিল, এরপর প্রোফাইল পিকচারটা দেখেই কেমন উদাস হয়ে গিয়েছিল অতনু, দিন সাতেক অনেক কিছু চিন্তা করার পর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, প্রায় দিন তিনেক পার হওয়ার পর অতনু যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তখন ঐন্দ্রিলা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছিল।
কোথায় আমি সময় নিলাম? আজকে দেখাতো আমিই করতে চেয়েছি, তোমার কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগছিল না, অনেক দিন ধরেই তো দেখছি!
ওয়েটার এল অর্ডার নিতে…।
এর পর থেকে শুধু ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েই থেকে যাওয়া, কখনো কোনো কথাবার্তা হয়নি। অতনু ভেবে পাচ্ছে না এ মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করবে! মেয়েটা পাত্তা না দিলে তো কথা আগানো যাবে না। অতনু অতটা গায়ে পড়া ছ্যাঁচড়াও হতে পারছে না যে আগবাড়িয়ে কথা শুরু করবে। এত্ত এত্ত মেয়ে তার পিছে লাইন দিয়ে থাকে, কিন্তু সে আটকালো এমন এক জায়গায় যে কোনো কূল–কিনারা নাই। এ এক মেয়ে যে তার মাথায় সারাক্ষণ ঘোরে, কত দিন কত কিছু ভাবছে সে তাকে নিয়ে…ছবি খুবই কম দেয় ফেসবুকে ঐন্দ্রিলা, যে কয়টা দিয়েছে সেগুলোতে দেখেছে অতনু খুব খুল্লামখুল্লা টাইপের নয়, চটকদারও নয়, কিন্তু খুবই স্নিগ্ধ একটা চেহারা, গভীর কালো চোখ, পরিমিত হাসি কিন্তু বেশ শান্তি শান্তি ভাবের একটা মুখশ্রী…দেখলেই মনে হয় কত চেনা, কত আপন! এমনো হয় নাকি? কিন্তু কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এমনটাই হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল প্রেমে পড়েছে, এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা আরও জটিল, মেয়েটাকে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে? নাকি মায়ায় আটকে গেছে! মায়া আবার আসে কোত্থেকে, কথাই তো হয়নি কোনোদিন! অদ্ভুত একটা বিষয়…কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারছে না।
না করে দিলে মরেই যাবে সে…ধুর, মরে যাওয়া কি এত সোজা নাকি? এমন সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মাসখানেক আগে অতনু একটা গানের লিঙ্ক পাঠিয়েছিল মেসেঞ্জারে, ঐন্দ্রিলা ১৪ ঘণ্টা পর সিন করেছিল কিন্তু কোনো রিপ্লাই দেয় নাই, অতনু আবার দুটো গানের লিংক পাঠাল। ঐন্দ্রিলা প্রায় ১০ ঘণ্টা পর সিন করেছিল এবং লাইক বাটনে প্রেস করে বরাবরের মতোই চুপ হয়ে গেল।
আচ্ছা এখন কী করবে সে? ঐন্দ্রিলা তো টেক্সট করেছে, ‘কেমন আছেন?’ কী উত্তর দিবে!!! অতনুর পাঠানো গানের লিঙ্কটাতে রিঅ্যাক্ট করেছে নীল হৃদয় দিয়ে! নীল কেন ? নীল তো বেদনার রং অনেক ভেবেচিন্তে অতনু রিপ্লাই দিল, ‘এই তো…আছি আমি, তুমি কেমন?’
ঘণ্টা দুয়েক পর ঐন্দ্রিলা টেক্সট দেখে মুচকি হেসে রিপ্লাই দিল, ‘আমি ভালো আছি, সাবস্ক্রাইব করতে হবে? youtube এ এটা আপনার চ্যানেল? অতনু কপাল কুচকে ফেলল, মেয়েটা কি কিছু বুঝতে পারেনি? এতটা বোকা তো মনে হয় না, নাকি এড়িয়ে গেল! রিপ্লাই দিল ‘আরে না, তোমাকে গান শোনার জন্য দিয়েছিলাম।’
ঐন্দ্রিলা রিপ্লাই দিল, ‘আমাকে কেন?’
এমনিতেই, ‘আমি অনেকেই গান পাঠাই শোনার জন্য’
‘ওহ্‌, আমি তাহলে ওই অনেকের লিস্টে ঢুকে গেছি?’
‘নাহ্‌, তা হবে কেন? তুমিও গান করো, ভাবলাম গানটা তোমার ভালো লাগবে…’
‘গান তো একটা না, পর পর কয়েকটা পাঠিয়েছেন
‘ওই একটা চিন্তা থেকেই পাঠানো’
‘আমি ছাড়া এই গানগুলো আর কতজনকে পাঠিয়েছেন?’
‘বেশ কয়জন’
‘তারা সবাই গান করে?’
‘মোটামুটি গান করে বা শুনতে পছন্দ করে’
ওহ্‌, তা আপনি ভালো নেই কেন? কী হয়েছে?
‘কে বলল ভালো নাই?’
‘আপনি তো বললেন, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেমন আছেন? বললেন ‘এই তো আছি’ ভালো তো বলেননি
‘ওহ্‌ এমনিতেই বলছি…’
‘নাহ্‌, এমনিতেই বলেননি, আপনি আসলেই ভালো নাই, কত দিন থেকে এমন?’
‘কেমন? কী বলো এসব…’।
‘আচ্ছা থাক, কিছু না, তবে আজকের গানটা তো শুধু আমাকে পাঠিয়েছেন অন্য কাউকে না এবং কয়দিন আগের পাঠানো গানটাও, এর আগেরগুলো অবশ্য জানি না।
‘খালি তোমাকে পাঠিয়েছি কে বলল, আরও কয়েকজনকে পাঠিয়েছি তো…’
‘শুধু শুধু মিথ্যা বলার দরকার নাই, আমি মিথ্যা বুঝতে পারি’
অতনু ঢোক গিলল, এখন কি রিপ্লাই দেবে ভাবছে…
‘আর কী বুঝতে পারো?’
‘সেটা আপনাকে বলব কেন? আচ্ছা যাই এখন, একটু কাজ আছে, ভালো থাকবেন, বাই’
ঐন্দ্রিলা চলে গেল, অতনুর মনে হলো সে একটা হার্টবিট মিস করল, অনেকক্ষণ ধরে বাই লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ইস্‌ মেয়েটা নিষ্ঠুর! এভাবে হুট করে কেউ চলে যায়…অতনু ঐন্দ্রিলার শেষ রিপ্লাই তে লাল হৃদয়ের রিঅ্যাক্ট দিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকল।
এভাবে আরও কয়েক দিন কেটে গেল হবে হয়তো পাঁচ দিন সাত দিন এমন কিছু, অতনু আর গানের লিংক পাঠাতে পারে না, সারাক্ষণ মনে হয় ধরা পরে যাবে…কিন্তু এখন অস্থিরতা আরও বেড়েছে, কী করবে সে, ফোন নম্বর চাইবে? সেটা কি ভালো দেখায়? একদিন বাইরে কোথাও দেখা করতে চাই, এটা বললে কেমন হয়? বন্ধুদের কাউকে বলতেও পারছে না, অতনুকে বাইরে থেকে যতই খোলামেলা উচ্ছল মনে হোক, মনবিষয়ক ব্যাপার-স্যাপার, এই সে একটু চাপা ভেতরে, সে একটু চাপা। সহজে কাউকে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু বলতে যে তাকে হবেই…।
ঠিক তখনই মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ, অতনু দেখতে নিল কে পাঠিয়েছে? সে অবাক হয়ে দেখে ঐন্দ্রিলা, কি কাকতালীয়, সে এতক্ষণ ঐন্দ্রিলার কথাই ভাবছিল। লিখেছে…।
‘কেমন আছেন? মন ভালো?
হ্যাঁ, ভালো আছি, তুমি?
আমিও ভালো আছি, গান শোনা ছেড়ে দিয়েছেন?
না, ছেড়ে দেব কেন?
‘তাহলে কি বুঝে ফেলেছেন যে আমি বুঝে গিয়েছি?’
‘কী বুঝে গিয়েছো?’
‘কিছু না, আপনি কি সবার সঙ্গেই এমন বোকা টাইপের আচরণ করেন? নাকি শুধু আমার সঙ্গে?’
আশ্চর্য তো, তুমি এসব কী বলছ?
‘আমি বলছি, সূর্য আজকে পূর্ব দিকে উঠেছে, পশ্চিমে ডুববে।
হ্যাঁ, সেটা তো রোজই হয়, চিরন্তন সত্য।
জি, এই তো ধরতে পেরেছেন, আমি চিরন্তন সত্য বলেছি।
কেমন?
‘কাউকে বিব্রত করতে চাই না, আচ্ছা তাহলে যাই, বাই’
অতনুর মনে হলো নিজের চুল নিজে ছিঁড়ে ফেলে, ঐন্দ্রিলা তো আবার চলে গেল! এখন উপায়? কেন সে কিছু বলতে পারে না! সাত দিন ধরে সে কি ভয়ংকর অপেক্ষা!! কত কিছু প্ল্যান করছে মনে মনে যে বলবে… ধ্যাততেরিকি ছাই!
ঐন্দ্রিলা ভাবছে ছেলেটা এমন কেন? একটু তারছেঁড়া…।
আরও কদিন গেল এভাবেই, ফেসবুকে কবিতা আপলোড বাড়ল…মেয়েদের কমেন্টের বন্যা বয়ে গেল, কে সে?
ঐন্দ্রিলা চুপচাপ, অতনু ইতস্তত স্তব্ধ।
দিন দশেক শেষ, এগারো দিনের মাথায় আবার একটা গান পাঠাল ঐন্দ্রিলাকে, এর বেশি সে আর কিছু পারছে না, কথা শুরু করতেও ভয়।
ঐন্দ্রিলা নীল হৃদয় দিয়ে রিঅ্যাক্ট করল, কিছু বলল না।
ঐন্দ্রিলা চলে গেল, অতনুর মনে হলো সে একটা হার্টবিট মিস করল, অনেকক্ষণ ধরে বাই লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ইস্‌ মেয়েটা নিষ্ঠুর! এভাবে হুট করে কেউ চলে যায়…অতনু ঐন্দ্রিলার শেষ রিপ্লাই তে লাল হৃদয়ের রিঅ্যাক্ট দিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকল।
অতনু সাহস করে লিখল, ভালো আছো?
‘হ্যাঁ, কিছু বলবেন?’
‘না, আমাকে তুমি তুমি বলতে পারো’
‘কেন?’
এমনিতেই
ও আচ্ছা, এমনি এমনি! আমরা কি একদিন বাইরে কোথাও দেখা করতে পারি?
কেন?
এমনিতেই আপনাকে কখনো দেখিনি…
আমিও তোমাকে দেখিনি
কিন্তু প্রায়ই তো আমার অ্যালবাম ঘেটে পুরোনো ছবিগুলো দেখেন…।
জানলে কী করে?
দেখা হলেই বলি।
আচ্ছা, বিকেল পাঁচটায় গ্লোরিয়াতে।
উহু, সাড়ে পাঁচটায় প্লিজ
আচ্ছা ঠিক আছে।
বৃহস্পতিবার বেলা ৫টা ৩০ মিনিটে গ্লোরিয়া জিন্স
অতনু গ্লোরিয়া জিন্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা নীল রঙের ফুল শার্ট পরা, ধূসর কালো প্যান্ট, জুতো। শার্টের হাতা কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত গুটানো, হাতে মোবাইল, কিছুটা ঘামছে সে…।
ঐন্দ্রিলা গাড়ো নীল রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে, গলায় ছোট মুক্তার মালা, হাতে মুক্তার আংটি, মুক্তার ব্রেসলেট, মুক্তা রঙের ব্যাগ ও স্যান্ডেল। অতনুকে দেখে মুক্তার দাঁত দিয়ে হাসল…।
অতনু হাসার চেষ্টা করল, এরপর দরজা দেখিয়ে ভেতরে ঢুকল, এত স্নিগ্ধ দেখতে একটা মেয়ে, চোখ এত গভীর, তাকাতেও লজ্জা লাগে, মনে হয় সব বুঝে ফেলবে! ওরা দুজনের মুখোমুখি একটা টেবিলে বসল, বসতেই ওয়েটার মেনু বুক দিয়ে গেল…।
কী খাবেন?
একটা কিছু হলেই হয়… তুমি কী নিবা?
কোল্ড কফি, মোকা।
আচ্ছা, তাহলে আমিও তা–ই নিই।
আপনাকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে,অবশ্য প্রেমে পরলে এমন হয় শুনেছি।
কে প্রেমে পরছে?
আমি না এখনো,
তাহলে?
ঐন্দ্রিলা শান্ত চোখে অতনুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি।
অতনু ভাবছে…, কী শান্ত, কিন্তু সাংঘাতিক মেয়ে, মুখে বলল এতই যদি বুঝো তাহলে এত সময় নিলে কেন?
কোথায় আমি সময় নিলাম? আজকে দেখাতো আমিই করতে চেয়েছি, তোমার কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগছিল না, অনেক দিন ধরেই তো দেখছি!
ওয়েটার এল অর্ডার নিতে…।
অর্ডার বুঝিয়ে দিল ঐন্দ্রিলা, তার জন্য লাটে আর অতনুর জন্য ক্যাপুচিনো, এরপর অতনুর দিকে তাকিয়ে দেখে, অতনু তাকিয়ে আছে তার দিকে।
জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি অন্তর্যামী?
মিষ্টি হেসে ঐন্দ্রিলা উত্তর দিল, না, এলিয়েন।
অতনু তার সর্ব সাহস দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, তোমার হাতটা একটু ধরি?
‘ধরো’
আর যদি না ছাড়ি?
আচ্ছা, শক্ত করে ধরে রেখো।
*লেখক: শায়লা জাবীন, অস্ট্রেলিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *