কবির প্রথম স্ত্রী ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অ্যাংলো মানে শ্বেতাঙ্গ বা আধা-শ্বেতাঙ্গ। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ফরাসি। ফলে তৎকালীন কলকাতার সমাজ অ্যাংলো ব্যাপারটা আদৌ মেনে নিতে পারেনি। তাই কবি হয়েছেন অবহেলিত। বাংলাদেশের যশোরের সাগরদাঁড়িতে জন্ম নেয়া কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিসৌধ কলকাতার শিয়ালদহ থেকে হাঁটাপথে আনুমানিক ১৫ মিনিট রাস্তা পার করলেই মল্লিকবাজার মোড়ের কাছে অর্থাৎ কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রিতে।
প্রশ্ন হলো- সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিসৌধ ভারতে কেন?
এই গুরুগম্ভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কবির জীবন আলেখ্য ও তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ঘণ্টায় টুংটাং আওয়াজ করলে যে তথ্যগুলো উঠে আসে তা হলো: প্রথমত, ব্রিটিশ ভারতীয় মধুসূদন দত্ত ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথম স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। রাজনারায়ণ কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন। তেরো বছর বয়স থেকেই মধুসূদন কলকাতায় বাস করতে থাকেন। খিদিরপুর অঞ্চলে সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্ক্স সরণি) তিনি একটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মাদ্রাজে অবস্থানকালীন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জুলাই রেবেকা ম্যাকটাভিশ নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকে বিয়ে করেন। মধুসূদনই প্রথম ভারতীয়, যিনি কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। মধুসূদনের একগুয়েমির কারণে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রেবেকা এবং তার চার সন্তানকে মাদ্রাজে রেখেই মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন। আর কোনো সম্পর্ক রাখেননি তাদের সাথে।
কলকাতায় ফিরে বিবাহ করেন ফরাসি তরুণী এমিলিয়া হেনরিয়েটাকে। তার সাথে তিনি আমৃত্যু ঘর করেছিলেন।
তৃতীয়ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডি বন্ধু গৌরদাস বসাককে উপহার পাঠালে, গৌরদাস সেটিকে জে ই ডি বেথুনের কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। এ গ্রন্থ পাঠ করে অভিভূত বেথুন মাইকেলকে চিঠি লিখে দেশে ফিরে আসতে এবং বাংলায় কাব্যরচনা করতে পরামর্শ দেন। পরে ১৮৫৬ সালে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন।
চতুর্থত, ২৯ জুন। সালটি ছিল ১৮৭৩। এ দিনই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মারা যান। মৃত্যুর ১৫২ বছর পর তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতির পটভূমির দিকে তাকালে স্তম্ভিত হতে হয়। ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, ১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। তার স্ত্রী হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়। অপরিমিত মদ্যপান, চিকিৎসার ধারাবাহিকতায় ছেদ, অমিতাচারের ফল শরীর সইতে পারেনি। উত্তরপাড়া লাইব্রেরির ওপর তলায় আশ্রয় পেলেন কবি। রইলেন ছয় সপ্তাহ। উত্তরপাড়ায় কবির শরীর-স্বাস্থ্য ও কার্যকলাপের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তাতে তার উচিত ছিল, পাঠগৃহে নয়, চিকিৎসাস্থল আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া। কারণ এ সময়ে তিনি এবং হেনরিয়েটা, উভয়েই খুব অসুস্থ ছিলেন। কে বেশি অসুস্থ বলা মুশকিল হলেও সুস্থতা দু’জনের ধারে কাছেও ছিল না। এই সঙ্কুল সময়ে মাইকেল আরামকেদায় বসে চোখ বুজে পড়ে থাকতেন। দেখলে মনে হতো, যেন একটি কঠিন হিসাব মেলাতে চেষ্টা করছেন। হায়! কী আশা করেছিলেন আর কী অর্জন করেছিলেন! সম্ভবত এ কারণেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের একমাত্র প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থের নাম তার জীবনেরই মতো এবং তার কবিতার উদ্ধৃতির মাধ্যমে বিধৃত: আশার ছলনে ভুলি, যার লেখক গোলাম মুরশিদ।
মাইকেল যখন নিদারুণ অসহায় অবস্থায় উত্তরপাড়ায় বসবাস করছেন, তখন হাওড়ায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসেন মাইকেল-বন্ধু গৌরদাস বসাক। তিনি এ সময়ে একাধিক বার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাইকেলকে দেখে আসেন। শেষ বার সেখানে তিনি যে দৃশ্য দেখতে পান, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তার বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে : ‘মধুকে দেখতে যখন শেষ বার উত্তরপাড়া সাধারণ পাঠাগারের কক্ষে যাই, তখন আমি যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখতে পাই, তা কখনো ভুলতে পারব না। সে সেখানে গিয়েছিল হাওয়া বদল করতে। সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়েছিল। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মধু একটুখানি উঠে বসল। কেঁদে ফেলল তারপর। তার স্ত্রীর করুণ অবস্থা তার পৌরুষকে আহত করেছিল। তার নিজের কষ্ট এবং বেদনা সে তোয়াক্কা করেনি।
সে যা বললো, তা হলো : আমি নুয়ে তার স্ত্রীর নাড়ী এবং কপালে হাত দিয়ে তার উত্তাপ দেখলাম। তিনি তার আঙুল দিয়ে তার স্বামীকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নিম্নকণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘আমাকে দেখতে হবে না, ওকে দেখুন, ওর পরিচর্যা করুন। মৃত্যুকে আমি পরোয়া করিনে।’
বাল্যবন্ধুর অন্তিম দশা দেখে গৌরদাস স্বভাবতই বিচলিত বোধ করেন। তিনি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন। জানা গেল, পরের দিন, ২০/২১ জুন (১৮৭৩), মধু নিজেই কলকাতা ফেরার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সপরিবারে কবি বজরায় করে নৌপথে নির্ধারিত দিনে অসুস্থ শরীরে নিজ উদ্যোগেই কলকাতা যাত্রা করলেন।
কলকাতায় হেনরিয়েটাকে ওঠানো হলো তার জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এভান্স ফ্লয়েডের বাড়িতে, ১১ নম্বর লিন্ডসে স্ট্রিটে। ইংরেজ এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়া লিন্ডসে স্ট্রিট চৌরঙ্গি রোডের সাথে সংযুক্ত। স্ত্রীর সংস্থান হলেও মাইকেলের নিজের ওঠার মতো কোনো জায়গা ছিল না। উত্তরপাড়ায় যাবার আগেই তিনি তার এন্টালির বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অগত্যা মাইকেল ঠাঁই নিলেন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। সে আমলে দেশীয় ভদ্রলোকরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে কালাপানি পার হওয়ার মতো শাস্ত্রবিরুদ্ধ একটি অসাধারণ ব্যাপার বলে বিবেচনা করতেন। ফলে এই হাসপাতালটি ছিল মূলত বিদেশী এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত।
কিছু বিশিষ্টজনের তদবিরে এবং মাইকেলের নিজের সাহেবী পরিচয়ের জন্য তিনি অবশেষে এ হাসপাতালে ভর্তির অনুমতি পেলেন। হাসপাতালে আসার পর প্রথম দিকে শুশ্রুষা এবং ওষুধপত্রের দরুণ তার রোগ লক্ষণের খানিকটা উপশম হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই তার স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে যায়। যকৃৎ, প্লীহা এবং গলার অসুখে তার দেহ অনেক দিন থেকেই জীর্ণ হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময়েই তার যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ। সেইসাথে হৃদরোগের লক্ষণও স্পষ্ট দেখা দেয়। সব মিলিয়ে তার শরীর শেষ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে একজন ‘সাহেব-কবি’ অকৃপণভাবে মধুভাণ্ড তৈরি করেছিলেন, যার স্বাদ পুরোপুরিভাবে তার স্বজাতি গ্রহণ করতে পারেনি। সেই মধুনির্মাতা মধুকবি মারা যাচ্ছেন শুনে আলিপুর হাসপাতালে অনেকের ভিড় দেখা যায়। তার চরম দুরবস্থার খবর শুনেও এতো দিন যারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তারাও এসে হাজির। রক্তের আত্মীয়তা সত্ত্বেও যারা একসময় তাকে ধর্মের কারণে ত্যাগ করেছিল, তাদের মনেও হয়ত করুণা বা লোকলজ্জা হানা দিয়েছিল–তারাও এলেন।
কবি তখন ভালো করেই অনুভব করতে পারছিলেন যে, তিনি মারা যাচ্ছেন; তবে ভালো হয়ে উঠবেন–এই স্বপ্নও তিনি দেখছিলেন। এরূপ বিপন্ন অবস্থাতেও তিনি বেহিসাবী স্বভাবের প্রভাবমুক্ত হতে পারেন নি। ধার করে হলেও ব্যয় করার এবং বদান্যতা দেখানোর প্রবণতা তিনি এ সময়েও ত্যাগ করতে পারেননি। হাসপাতালে তার সাথে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন তার এক সময়ের মুন্সি মনিরউদ্দিন। কবির কাছে তার চার শ’ টাকা পাওনা ছিল। তারপরেও উল্টো কবি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো টাকা পয়সা আছে কি-না? মনিরউদ্দিন তার কাছে মাত্র দেড় টাকা আছে বলে জানালেন। সেই পয়সাই তিনি চাইলেন। তারপর তা বকশিস হিসেবে দান করলেন তার শুশ্রুষাকারিণী নার্সকে। মৃত্যুকালেও ধার করে বকশিশ দেবার এই আচরণ সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ তার সারা জীবনের অভ্যাসের সাথে।
কবি হাসপাতালে ছিলেন সাত অথবা আট দিন। এ সময়ে কিছু চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন পেলেও কবি খুব একটা মানসিক শান্তিতে ছিলেন না। পরিবার সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তা এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তার উদ্বেগ তাকে বিচলিত করে। এরই মাঝে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত চরম অসুস্থ কবি এক পুরনো কর্মচারীর মাধ্যমে ২৬ জুন (১৮৭৩) একটি মর্মান্তিক বেদনার খবর পেলেন–স্ত্রী হেনরিয়াটার মৃত্যুর সংবাদ। মাত্র ৩৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিন বয়সে হেনরিয়েটা মারা গেলেন।
হেনরিয়েটা বয়ঃসন্ধিকালে মা মারা যাবার পর থেকে সুখের মুখ কমই দেখেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত পরিবেশ ত্যাগ করে তিনি মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসেছিলেন মাইকেলের ভালোবাসার টানে। চার্চে গিয়ে সেই ভালোবাসার কোনো স্বীকৃতি পর্যন্ত তিনি আদায় করতে পারেননি। এমন প্রেয়সীর মৃত্যু সংবাদ কবির কাছে প্রচণ্ড আঘাত হয়ে এসেছিল।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মাইকেলের মুখ থেকে প্রথম যে কথাটি বের হয়: ‘বিধাতঃ, তুমি একইসাথে আমাদের দু’জনকে নিলে না কেন ?’
হেনরিয়েটার শর্তহীন ভালোবাসা এবং নীরব ত্যাগের কথা অন্য সবার চেয়ে মাইকেলই ভালো করে জানতেন। সুতরাং যতো অনিবার্য হোক না কেন, হেনরিয়েটার প্রয়াণে মৃত্যুপথযাত্রী কবি খুবই মর্মাহত ও বিষন্ন হয়েছিলেন। এর ফলে তার অসহায়ত্ব ও যন্ত্রণা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি খুবই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন হেনরিয়েটার অন্তেষ্টিক্রিয়াটার ব্যাপারে। এর জন্যে যে অর্থ, যোগার-যন্ত্র লাগবে, তা কোথা থেকে আসবে? তিনি সঞ্চয়ী লোক ছিলেন না। কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে মাইকেল তখন নিজেও মৃত্যু পথযাত্রী।
এই দিনই অথবা পরের দিন হাসপাতালে শয্যাগত মাইকেলের কাছে স্বজন মনোমোহন ঘোষ আসেন তার সাথে দেখা করতে ও সান্ত্বনা দিতে। কবি তাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, ঠিকমতো হেনরিয়েটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কিনা। মনোমোহন জানালেন, সবই যথারীতি হয়েছে। মাইকেল জানতে চান, বিদ্যাসাগর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এসেছিলেন কিনা। মনোমোহন জানালেন, এদের খবর দেয়া সম্ভব হয়নি; অর্থাৎ আসেননি। স্ত্রী বিয়োগের ফলে অসহায় কবির সামনে আরেকটি মারাত্মক উদ্বেগের কারণ এসে উপস্থিত হয়: দু’ ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা। তার ছেলেদের একটির বয়স তখন মাত্র বারো এবং অন্যটির মোটে ছয়।
ধর্মান্তরিত মাইকেলের অবস্থা এমন ছিল যে, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং রেভারেন্ড চন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বরং কবির পারলৌকিক মঙ্গল নিয়ে কবির চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। বিশেষত চন্দ্রনাথ কবিকে এ সময়ে বারবার নাকি পরম ত্রাতা যীশু খ্রিস্টের কথা মনে করিয়ে দেন। মাইকেল জীবনীকার গোলাম মুরশিদ লিখেন : ‘পারলৌকিক মঙ্গলের ব্যাপারে তাদের এই উৎকণ্ঠা দিয়ে নিজেদের অজ্ঞাতে তারা কবির প্রতি যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা করেন বলেই মনে হয়।’
২৮ জুন তারিখে সমস্ত আশা-ভরসাহীন, রোগকাতর, বিষন্ন কবি যখন কেবলমাত্র মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, তেমন সময়ে চন্দ্রনাথের সাথে এসে যুক্ত হন কৃষ্ণমোহন। উদ্দেশ্য: খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী কবির শেষ স্বীকারোক্তি আদায় করা। কবি কোনো পাপের কথা স্বীকার করে বিধাতার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, এমন তথ্য কেউ জানেন না। এহেন পরিস্থিতিতে কৃষ্ণমোহন এবং চন্দ্রনাথ আশঙ্কা প্রকাশ করে কবিকে জানান যে, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে, তা নিয়ে গোলযোগ দেখা দিতে পারে।
এমন আস্থাহীন অবস্থায় মাইকেলের নির্ভীক উত্তর ছিল : ‘মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তার সর্বোত্তম বিশ্রামস্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন–আপনাদের দরজার সামনে অথবা গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।’
২৯ জুন ১৮৭৩, রোববার, মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এলো। তার হিতাকাঙ্ক্ষী এবং সন্তানরা এলেন তাকে শেষ বারের মতো দেখতে। এমন কি, তার যে জ্ঞাতিরা হিন্দুধর্ম ত্যাগের কারণে তার সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে মাত্র একজন এসেছিলেন তাকে দেখতে। জীবনের শেষ দু’ বছর কবির নিদারুণ দুর্দশায় সহায়তার হাত প্রসারিত না করলেও, শেষ মুহূর্তে মৃত্যুপথযাত্রী কবিকে দেখে অনেকেই করুণায় বিগলিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্রামহীন, আঘাতে-উদ্বেগে-পীড়ায় জর্জরিত এবং রোগশীর্ণ দেহ কবি আর ধরে রাখতে পারলেন না। বেলা ২টার সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন চিরদিনের জন্যে।
মাইকেলের ক্ষেত্রে মৃত্যুপরবর্তী ধর্মীয় কাজের সমস্যাজনীত আশঙ্কা প্রবলভাবে সত্যে পরিণত হলো। তার মৃত্যুর পর সত্যি সত্যিই তার শেষকৃত্য নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দিলো। যদিও মৃত্যুর শেষ বিদায়ে থাকার কথা ক্ষমা ও প্রার্থনা, মাইকেলকে সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হলো।
কলকাতার তৎকালীন খ্রিস্টান সমাজ তার দীক্ষার ঘটনা নিয়ে ঠিক তিরিশ বছর আগে একদিন মহা হইচই করলেও, মৃত্যুর পর তাকে মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিতেও রাজি হলো না। ইংলিশম্যানের মতো পত্রিকাগুলো তার মৃত্যুর খবর পর্যন্ত ছাপলো না। যদিও সে সপ্তাহে কলকাতায় মোট কয়জন দেশীয় ও খ্রিস্টান মারা যান এবং আগের সপ্তাহের তুলনায় তা বেশি, না কম, সে পরিসংখ্যান নিয়েও পত্রিকাটি আলোচনা করে। মিশনারিদের কাগজ ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া খুবই সংক্ষেপে তার মৃত্যু সংবাদ ছাপালো।
সংবাদটি তার কবি-কৃতির ধারে-কাছে দিয়েও গেল না, পত্রিকাটি গুরুত্বের সাথে যা ছাপালো, তা হলো, তার জীবন-যাপনের অভ্যাসগুলো ছিল অনিয়মে ভরা আর তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া আরেকটি প্রসঙ্গ এ পত্রিকায় উল্লেখিত হয়েছিল–’তিনি তার তিনটি সন্তানের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেন নি।’
নবদীক্ষিত খ্রিস্টান মাইকেলের প্রতি খ্রিস্টান সমাজ যে মনোভাব দেখায়, তা দুঃখজনক এবং তার পূর্বতন স্বজাতি হিন্দু সমাজের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতের সাথে তুলনীয়। তবে মৃত্যুকালীন আচরণ অভাবনীয় কঠোরতা আর ক্ষুদ্রতার পরিচয় বহন করে। কেননা, মৃত্যুর পরে মৃতের প্রতি এ রকমের রোষের ঘটনা কদাচিৎ দেখা যায়। যার সাথে মাইকেলের কবিতার মিল না থাকলেও, ব্যক্তিগত জীবনে অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়, সেই শার্ল বোদলেয়ারের মৃত্যুর পরেও তার প্রতি অনেকের আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছিল। তার স্বীকারোক্তি-বক্তব্য নিয়ে, তার কবিকৃতি নিয়ে অনেকে বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যসাধকদের বেশির ভাগই তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসেননি। কিন্তু ফরাসি সমাজ তার লাশ অন্তেষ্টিক্রিয়ার ঘটনা নিয়ে এমন অমানবিক আচরণ করেনি, যেমনটি করা হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ক্ষেত্রে।
জুনের শেষ ভাগে দারুণ গ্রীষ্মের সময়ে মাইকেলের মৃত্যু হলেও, খ্রিস্টান সমাজের সৃষ্টি-ছাড়া রোষের দরুণ সেদিন এবং সেদিন রাতে তার লাশ পড়ে থাকল দুর্গন্ধ-ভরা নোংরা মর্গে। কৃষ্ণমোহন ছিলেন কলকাতার খ্রিস্ট ধর্মযাজকদের মধ্যে একজন প্রবীণ সদস্য, যদিও তিনি এ সময়ের অনেক আগে থেকেই সরাসরি ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশপস কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন এবং মাইকেল মারা যাওয়ার আগের সময়কালে অধ্যাপনা থেকেও অবসর নিয়েছিলেন, তিনি উদ্বিগ্ন চিত্তে নিজে ছুটে গিয়ে তদবির করলেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যানের কাছে। মিলম্যান এর ছয় বছর আগে বিশপ হয়ে কলকাতায় আসেন। দেশীয়দের এবং স্থানীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি বাংলাসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় ভাষাও শিখে নিয়েছিলেন।
এমন কি, তিনি নিজে দু’ খণ্ডে মাইকেলের প্রিয় কবি ত্যাসোর জীবনীও লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি তার ধর্মযাজকদের ‘বিতর্কিত’ বিষয়ে যোগ দানে বাধা দিলেন। এহেন লর্ড বিশপ রবার্ট মিলম্যান মাইকেলের মৃত্যুর পরের দিন সকালেও কবির লাশ খ্রিস্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন না! অন্যদিকে মাইকেলের স্বদেশবাসী ও ধর্মগোষ্ঠীর হিন্দু সমাজও তাকে গঙ্গার ঘাটে পোড়াতে আগ্রহী হলো না। সুতরাং আষাঢ় মাসের ভেপসা গরমের মধ্যে মাইকেলের অসহায় লাশ মর্গেই পচতে থাকে। স্বধর্ম ও স্বজাতির কাছে ‘সিদ্ধান্তহীন ও আগ্রহরহিত’ মাইকেলের নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন লাশ তৎকালীন কলকাতার বাঙালি হিন্দু ও খ্রিস্ট সমাজের কাছে কলঙ্কচিহ্নস্বরূপ অপাঙতেয় ছিল।
অবশেষে মাইকেল-লাশ-সমস্যার সমাধান হলো, যখন সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক। তিনি কবির লাশ সমাধিস্থ করার সংকল্প প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে অ্যাংলিকান চার্চের একজন সিনিয়র চ্যাপেলেইন–রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো, বিশপের অনুমতি ছাড়াই তার লাশ সমাধিস্থ করার উদ্যোগ নেন।
৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে, কবির লাশ নিয়ে তার ভক্ত এবং বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় হাজার খানেক মানুষ এগিয়ে যান লোয়ার সার্কুলার রোডের খ্রিস্টান গোরস্থানের দিকে।
সেই লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে মাত্র চার দিন আগে কবিপত্নী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির জন্যে কবর খোঁড়া হয় স্ত্রীর কবরের পাশে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো নামকরা পাদ্রী বা ধর্মীয় নেতা তার অন্তেষ্টিক্রিয়ায় এসেছিলেন বলে জানা যায়নি। এমনকি, কৃষ্ণমোহনও নন। অনেক পাদ্রী বরং তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন। রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোই কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা করেন। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত চার্চের রেজিস্টারে কবিকে এবং তার স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই।
চাঞ্চল্যকর জীবনালেখ্য ও ইতিহাসভিত্তিক এই চারটি তথ্য কবির সমাধিসৌধ বা কবরের ব্যাপারে যৎসামান্য হলেও স্পষ্ট করে।
ক. তেরো বয়স থেকে কলকাতায় বেড়ে উঠায় ওখানকার প্রকৃতি ও মাটির প্রতি কবির দুর্বলতা ছিল।
খ. বন্ধু যখন দেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানায়, কবি তখন কলকাতাতেই ফিরে আসেন।
গ. কবির প্রথম স্ত্রী ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। অ্যাংলো মানে শ্বেতাঙ্গ বা আধা-শ্বেতাঙ্গ। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ফরাসি। ফলে তৎকালীন কলকাতার সমাজ অ্যাংলো ব্যাপারটা আদৌ মেনে নিতে পারেনি। তাই কবি হয়েছেন অবহেলিত। তাদের ভাবনা, দরিদ্র ও অভিভাবকহীন কবির লাশ-সমস্যাকে যেনতেনভাবে সমাধান করলেই হলো!
ফলশ্রুতিতে, কলকাতার খ্রিস্ট ও হিন্দুদের কাছে তার কবরের ওপর সবুজ ঘাস চাওয়া অর্থাকষ্টে জর্জরিত কবির অন্তেষ্টিক্রিয়াই ছিল সন্দিহানে। হবে কি হবে না? নাকি মর্গেই পচবে নিথর দেহ!
তবে হলো- নাটকীয় অন্তেষ্টিক্রিয়া!
যদিও কবি মনের অজান্তেই একবার লিখে ফেলেছিলেন, সাগরদাঁড়ি তথা জন্মভূমির প্রতি দুর্বল তবে চিরন্তন প্রেমের কথা-
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তববঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতিবিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃতদত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরেজন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতিরাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী’