এ নিয়ে মোট সাতবার জাপান-বাংলাদেশ আলোচনা হলো। কিন্তু জাপান অর্থায়নে এখনো সাড়া দেয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়নের খোঁজ চলছে। কিন্তু পাতাল রেলে অর্থায়নে কেউ রাজি হচ্ছে না।
প্রকল্পের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুরো ঢাকাকে মাটির নিচ দিয়ে যোগাযোগের একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত করার ভাবনা থেকেই ঢাকা সাবওয়ে প্রকল্পের সূচনা হয়। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১১টি পথ চূড়ান্ত করা হয়। তাতে পথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২৩৮ কিলোমিটার। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর আরও একটি পথ যুক্ত করা হয়। এতে দৈর্ঘ্য আরও ২০ কিলোমিটার বাড়ে।
সম্ভাব্যতা যাচাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে স্পেনের টিপসা। তৎকালীন সরকার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ৩২১ কোটি টাকা খরচ করে। মূলত পাতাল রেলের স্বপ্ন দেখতেই ওই টাকা খরচ হয়। অঙ্কের হিসাবে, এক কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ হবে ৩৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি ৬৮ লাখ ৭৮০ টাকা।
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী, পুরো কাজটি তিনভাগে বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। প্রথম ধাপে চার পথে থাকছে ১০৫ কিলোমিটার রেললাইন। এ ক্ষেত্রে ঢাকা সাবওয়ের প্রথম ধাপের কাজ শেষ করতে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা লাগবে।
জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘বেশ কিছু পর্যায়ে অর্থায়নের জন্য আলোচনা চলছে। জাপান এখনো জবাব না দিলেও আমরা আশাবাদী। এমন বড় প্রকল্প সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রথম ধাপের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েই চেষ্টা চলছে।’
প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০৫০ সালে মাটির নিচ দিয়ে পুরো ঢাকাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। সাবওয়ে নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণজনিত কোনো ঝামেলা নেই। সাবওয়েটি নির্মিত হলে প্রতিদিন ঢাকা মহানগরের প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী মাটির নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন। এতে নগরে যানজট কমবে। মেট্রোরেলের মতোই পাতাল রেলও পুরোপুরি বিদ্যুৎনির্ভর থাকবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিবিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী ফেরদৌস কালবেলাকে বলেন, ‘যমুনা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছিল ৭০-এর দশকের শুরুতে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলো আসলে সরকারের ওপর থেকে নিচ দিকে বাস্তবায়িত হয়। চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজটা গুছিয়ে শুধু ওপরে দিয়ে দেন। সরকারের পলিসি কী হবে সেটার ওপর এমন কাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।’
রাজউকের ঢাকার নকশায় নেই সাবওয়ে : পাতাল রেল পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ঢাকার জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, ২০৭০ সালে গণপরিবহন ব্যবস্থা সেটা সামাল দিতে পারবে না। এমনকি মেট্রোরেলও হিমশিম খাবে। তাই যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে পাতাল রেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
যদিও এ নিয়ে ভিন্নমতও আছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘লাখ কোটি টাকা ব্যয় করে মাটির নিচে ট্রেন চালানোর চিন্তা করছি। অথচ মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা ঠিক করা সম্ভব। ঢাকা নিয়ে রাজউকের পরিকল্পনায় পাতাল রেলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু আমরা এটা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বাসের ব্যবস্থা ঠিক না করে বিদ্যুৎনির্ভর এত ব্যয়বহুল প্রকল্প আমরা কেন হাতে নিচ্ছি, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।’
প্রথম ধাপের প্রস্তাবিত চার রুট
রুট-১ : কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত। এই ৩৫ কিলোমিটার পথে থাকবে মোট ২৪টি স্টেশন। ঝিলমিল, তেঘরিয়া বাজার, মুসলিমনগর, সদরঘাট, গুলিস্তান, কাকরাইল, হাতিরঝিল, বিজি প্রেস, রজনীগন্ধা মার্কেট, ভাসানটেক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কালশী, উত্তরা সেক্টর-১৭, নর্থ বাউনিয়া, উত্তরা সেক্টর-১৪, উত্তরা সেক্টর-১০, মাছিমপুর ও টঙ্গী জংশন এলাকায় স্টেশন করা হবে।
রুট-২ : গাবতলী থেকে ভোলাব ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার এলাকায় ১৪টি স্টেশন হবে। গাবতলী, গোলারটেক, তুরাগ সিটি, জাতীয় চিড়িয়াখানা, পূর্বাচল, গাবতলী-ভোলাব ইউনিয়ন সেক্টর-১১, পূর্বাচল সেক্টর-২১, পূর্বাচল সেক্টর ইস্ট, পূর্বাচল মালুম সিটি ও ভোলাব ইউনিয়নে স্টেশন হবে।
রুট-৩ : কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর প্রায় সাড়ে ২৬ কিলোমিটারে ১৫টি স্টেশন হবে। কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, চকবাজার, নয়াবাজার, কেরানীগঞ্জ-সূত্রাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, সানারপাড়, মৌচাক, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর ও সোনাপুরে স্টেশনগুলো তৈরি হবে।
রুট-৪ : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার পথে ৩২টি স্টেশন হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আশুলিয়া মডেল টাউন ইস্ট, উত্তরা সেক্টর-১৬, উত্তরা নর্থ, আজমপুর কাঁচাবাজার, শাহ কবীর মাজার নর্থ, আফতাবনগর নর্থ, ওয়েস্ট নন্দীপাড়া, গ্রিন মডেল টাউন, মাতুয়াইল রোড, নন্দিপাড়া দক্ষিণ, বরুয়া সাউথ, বসুন্ধরা সাউথ, সান ভ্যালি উত্তর পাড়া, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, ইস্ট মোহাম্মদবাগ, ফতুল্লা স্টেশন, ডিসি অফিস নিউ কোর্ট ও নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকায় হবে রেলস্টেশন।
বর্তমান সেতু সচিব একসময় মেট্রোরেলের পরিচালন প্রতিষ্ঠান ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সেদিক থেকে দুই প্রতিষ্ঠানই তার চেনা। সেই বিবেচনায় এক প্রশ্নের জবাবে সেতু সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ‘আমি বলেছি, মেট্রোরেলের বিদ্যমান কোনো লাইনের সঙ্গে যেন সাবওয়ের কোনো লাইন সাংঘর্ষিক না হয় সেদিকে খায়াল রাখতে। এখন সাবওয়ের নির্মাণকাজ সেতু কর্তৃপক্ষ করতে পারবে, আইনি সমস্যা নেই।’
কাজ শুরুর আগেই বেড়ে গেছে খরচ : পুরো ঢাকাকে পাতাল রেলের আওতায় আনতে শুরুতে খরচ ধরা হয় ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। তবে প্রথম ধাপে চার রুট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। কিন্তু তখন ডলারের বিপরীতে টাকার মান নির্ধারিত ছিল। এখন মুক্ত বাজারের কারণে টাকার মান আরও কমে গেছে। ডলারের হিসাবে ব্যয় এক জায়গায় থাকলেও টাকার হিসাবে খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের হিসাবে, চার রুটের মধ্যে ঝিলমিল থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার রুটে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। গাবতলী থেকে ভোলাব ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার পথে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। কেরানীগঞ্জ-সোনাপুর প্রায় সাড়ে ২২ কিলোমিটার পথে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ২ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার রুটে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
ব্যয় সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ডলারের দামের পাশাপাশি নির্মাণকাজ শুরুর আগে নির্মাণসামগ্রীর দাম আরও বাড়বে। কাজ যত দেরিতে শুরু হবে খরচ তত বাড়বে। আবার মাটির নিচের প্রকল্পে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বেশি হয়। মাটির ২৫ থেকে ৭০ মিটার নিচে রেল চলাচল করবে। মাটির যত নিচে প্রকল্প হবে, ব্যয় তত বাড়বে।
ডিএমটিসিএল থাকতে সাবওয়ে কেন বিবিএর করবে : প্রথাগত রেলের বাইরে ঢাকায় এখন মেট্রোরেল চলছে। মহানগরকেন্দ্রিক ট্রেনকে মেট্রোরেল বলা হচ্ছে। মেট্রোরেলের আইন অনুযায়ী, একটি কোম্পানির অধীনে এ ধরনের রেলপথ নির্মাণ ও ট্রেন পরিচালনা করতে হবে। মেট্রোরেলের জন্য ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান মেট্রোর কাজও করছে।
কিন্তু সাবওয়ে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিবিএকে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় মেট্রো নির্মাণ করার এখতিয়ার সেতু কর্তৃপক্ষের ছিল না। পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর নীতি সংশোধন করে ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে বিবিএ।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলছেন, ‘কোম্পানি ছাড়া সাবওয়ের কাজ এগোবে না। এটা তো শুধু নির্মাণের বিষয় নয়। সাবওয়ে পরিচালনাও করতে হবে। ডিএমটিসিএল পরিচালনার কাজ করতে পারে, আবার নতুন কোম্পানিও হতে পারে।’