স্টাফ রিপোর্টার: বর্তমানে ৫৮টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও এর অধীনস্থ সংস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরত ৮৯ হাজার ২৩৫ জন। তাদের সবার তথ্য যাচাই-বাছাই করছে সরকার। ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়ার বিপুল অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে অন্তবর্তীকালীন সরকার এসব সনদ যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দপ্তর সংস্থার কাছে তথ্য চেয়ে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান বাদে ৫৮টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরতদের তথ্য জমা পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করছেন—এমন সবার তালিকা চেয়েছে সরকার। এরই মধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তালিকা দিয়েছে। এর সংখ্যা প্রায় ৮৯ হাজার। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। যাচাই-বাছাই করার জন্য একটা কমিটি করা হয়েছে। তারা গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ করছে।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে তাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরির অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কোটা চালু করে সরকার। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রায় ৩০ হাজার নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে। সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জননিরাপত্তা বিভাগ ও বাংলাদেশ পুলিশে। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদধারী নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ না করে অনেকে প্রভাব খাটিয়ে ও দুর্নীতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। অনেকে ভুয়া সনদ তৈরি করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার বয়স নিয়েও বিভিন্ন সময় নানা প্রশ্ন ওঠে। ৪-৫ বছর বয়সীদেরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার নজির রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও আগের সব সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধ না করে ক্ষমতার প্রভাবে তাদের বাবা, চাচা, ভাই ও নিজের নামে সনদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ বহু রয়েছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে কোটা বাতিলের দাবিতে গত বছর জুলাই মাসে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানায় সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও পুলিশ হামলা করে। হামলায় শিক্ষার্থীরা আহত ও নিহত হওয়ায় সারা দেশে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মুখে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সভায় স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার আওতায় গ্রেড অনুযায়ী কতজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন, সে তালিকা করার নির্দেশ দেন।
সভায় উপদেষ্টা বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ইমেজ সংকটে পড়েছেন। উপদেষ্টার নির্দেশনার পর ১৫ আগস্ট প্রথম দফায় ‘অনতিবিলম্বে’ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরতদের তথ্য চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পৃথক চিঠি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে সরকারি চাকরিতে প্রথম (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার), দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের জীবনবৃত্তান্তসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়া হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের পিতা-মাতা, পিতামহ-মাতামহের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নম্বর এবং চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার তথ্যও উল্লেখ করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসহ ৫৯টি সরকারি সংস্থার মধ্যে ৫৮টির তথ্য পাওয়া গেছে। এরমধ্যে শুধু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তথ্য নেই। বাকি ৫৮টি সরকারি সংস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করছেন ৮৯ হাজার ২৩৫জন। নতুন করে এদের সবার তথ্য যাচাই-বাছাই করছে সরকার। যে মুক্তিযোদ্ধার সনদের বলে তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি করেছেন সেই মুক্তিযোদ্ধার সব তথ্য ঠিক আছে কি না, তাও যাচাই-বাছাই করছে মন্ত্রণালয়। এ জন্য আলাদা করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সালাউদ্দিনকে যুক্ত করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এক ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করে এই তদন্ত কমিটি কাজ করছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী।
কোন দপ্তর, সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে কতজন : বর্তমানে ৫৮টি দপ্তর, সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরত ৮৯ হাজার ২৩৫ জনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ১৬ জন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ- অর্থ মন্ত্রণালয়ে ১৭, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়- বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে ১২, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ১০১, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ১৩, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ১৩২, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ১, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০৬, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ১৮১, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১২, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয় ৭৪০৭, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ১৩২, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৭১, সেতু বিভাগ ১২, পরিকল্পনা বিভাগ ২৯, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ৪২৮৬, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ৫৬, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ৭৯, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩৯, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০৯, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ৭০, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪৫, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ ৯, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২৭, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ২২১, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ ৬৮১, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৩৩০, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ১১৫, বিদ্যুৎ বিভাগ ৩৬৬, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ১০০, ভূমি মন্ত্রণালয় ৭৬, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ৯৯৭ জন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ৩০৩, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২৫৭, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬৮, অর্থ বিভাগ ১৮৯, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ২৪৩০, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৩৭, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৪, খাদ্য মন্ত্রণালয় ১২৫২, শিল্প মন্ত্রণালয় ৫৪২, সুরক্ষা সেবা বিভাগ ২১০১, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১৭৩২, স্থানীয় সরকার বিভাগ ১১৯১, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৪৮৯, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২১৮, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ৮১০, গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগ ২৬৮, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৪, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২২৫, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৮১১, আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩২৮, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৯৪৮৫, জননিরাপত্তা বিভাগ ও বাংলাদেশ পুলিশ ২৩০৬৩, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয় ৫৬, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৪৮৩৫, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৬১৭, কৃষি মন্ত্রণালয় ১৮৫২ জন।