মূল্যস্ফীতি কী, কেন হয়, কীভাবে আপনার পকেট খালি করে

আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, জিনিসপত্রের দাম কীভাবে বেড়েই চলেছে? উদাহরণ দিচ্ছি—

২০২১ সালের জুলাই মাসে এক কেজি ভালো মানের চালের দাম ছিল ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু আজ সেই চালের দাম ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা।

এটি শুধু খাবারের ক্ষেত্রেই নয়। বেড়েছে সবকিছুরই দাম। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কী হচ্ছে? দাম কেন বেড়েই চলেছে? দাম কেন একই থাকে না? সব বিক্রেতারা কি ইচ্ছাকৃতভাবে একসঙ্গে দাম বাড়াচ্ছেন?

আসলে এর পেছনে একটি বড় কারণ আছে। আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতির এই পরিভাষা এখন অনেকেই জানেন। কিন্তু আমরা কি সত্যিই জানি মূল্যস্ফীতি কেন ঘটে এবং এটি কি সব সময় খারাপ কিছু? আসুন ব্যাখ্যা করি।

মূল্যস্ফীতি কী

মূল্যস্ফীতি আসলে খুবই সহজ একটি বিষয়। মূল্যস্ফীতি তখন ঘটে, যখন সময়ের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। ফলে টাকার মান কমে যায়। এ জন্যই চাল কিংবা অন্য যেকোনো পণ্য এখন আগের তুলনায় বেশি দামি লাগে। যখন মূল্যস্ফীতি ঘটে, তখন আপনার টাকা আগের মতো জিনিস কিনতে পারে না।

সেই গল্পটা এখানে বলা যায়। আগে মানুষ পকেটভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে ব্যাগভর্তি বাজার আনতেন। এখন ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে পকেটভর্তি বাজার আনতে হয়।

আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৭২ সালে এক কেজি খাসির মাংস পাওয়া যেতে পাঁচ টাকায়। এখন পাঁচ টাকা দিয়ে ছোট্ট একটুকরা হাড্ডিও মিলবে না। অর্থাৎ টাকার মান কমে যাচ্ছে, সবকিছু আগের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল মনে হচ্ছে।

কিন্তু এটা কেন ঘটে?

মূল্যস্ফীতি কেন ঘটে

মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে, তবে আমরা সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

১. চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি বা ডিমান্ড-পুল ইনফ্লেশন

যখন অনেক মানুষ কোনো পণ্য কিনতে চায়, কিন্তু সেই পণ্যের পরিমাণ কম থাকে, তখনই এটি ঘটে। ধরা যাক, সাধারণভাবে মানুষ এক হাজার কেজি চাল কিনতে চান এবং কৃষকেরা ঠিক এক হাজার কেজিই উৎপাদন করেন। অর্থাৎ সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু হঠাৎ একটি বন্যা বা অন্য কোনো কারণে চালের ফসল নষ্ট হয়ে গেল। ফলে অবশিষ্ট থাকল মাত্র ৩০০ কেজি চাল। অর্থাৎ চাহিদা আগের মতোই রয়ে গেছে, কিন্তু জোগান বা সরবরাহ কমে গেছে। ফলে মানুষ একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কিনতে চায় এবং দাম বাড়ে। এতে এক কেজি চালের দাম আগে ছিল ২০ টাকা, এখন তা ২৫ টাকা হয়ে যায়। যখন মানুষ কোনো পণ্য কিনতে প্রতিযোগিতা করে, তখন তারা দামের ওপর টান দেয়—এটিই চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি।

২. ব্যয়চালিত মূল্যস্ফীতি বা কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন

যখন জিনিসপত্র তৈরির খরচ বেড়ে যায়, তখন এটি ঘটে। ধরুন, একজন মুড়ি বিক্রেতা ১ কেজি মুড়ি ৩০ টাকায় বিক্রি করেন। চাল কিনে তাঁকে মুড়ি ভাজতে হয়। কিন্তু বন্যায় তো চালের ফলন নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মুড়ি বিক্রেতারও বেশি দামে চাল কিনতে হয়। এক কেজি মুড়ি বানাতে আগে লাগত—চাল এক কেজি ২০ টাকা, অন্যান্য খরচ ৫ টাকা, লাভ ৫ টাকা। মোট ৩০ টাকা।

কিন্তু এখন চলের দাম বেড়ে হয়ে গেছে ২৫ টাকা। বাকি সব খরচ একই থাকলেও লাভ করতে হলে বিক্রেতাকে এখন দাম বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করতে হবে।
এটিই হলো ব্যয়চালিত মুদ্রাস্ফীতি, যখন উৎপাদন ব্যয় দাম বাড়িয়ে দেয়।

৩. অন্তর্নিহিত মূল্যস্ফীতি বা বিল্ট-ইন ইনফ্লেশন

এটি ঘটে, যখন মূল্যবৃদ্ধি জীবনের ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং কর্মীরা বেশি বেতন দাবি করেন।

ধরা যাক, একটি জুতা তৈরি কারখানার কর্মীদের গড় জীবনযাত্রার খরচ ২০ হাজার টাকা এবং তারা মাসে ২৫ হাজার টাকা আয় করে। অর্থাৎ তারা ব্যয় মিটিয়ে কিছুটা সঞ্চয় করতে পারে। কিন্তু দাম বেড়ে গেলে তাঁদের মাসিক ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকা। ফলে তাঁরা বেতন বাড়ানোর দাবি জানানো শুরু করেন। যদি কোম্পানি বেতন ২৫ হাজার টাকা করে, তবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে কারখানাও তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এভাবে বেতন ও দাম একে অপরকে টানে এবং একটি চক্র তৈরি হয়।

৪. অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ

যখন অর্থনীতিতে অতিরিক্ত টাকা থাকে, তখনো দাম বেড়ে যেতে পারে। ধরা যাক, একটি রুটির দাম ১০ টাকা এবং পাঁচজনের কাছে রুটি কেনার জন্য ১০ টাকা করেই আছে। ফলে প্রত্যেকে একটি করে রুটি কিনছে। অর্থাৎ সব ঠিকঠাকই আছে।

কিন্তু যদি সরকার প্রত্যেককে আরও ১০ টাকা করে দেয়, তাহলে প্রত্যেকের কাছে এখন আছে ২০ টাকা। ফলে সবাই এখন দুটি রুটি কিনতে চায়, কিন্তু রুটি তো এখনো ৫টি! বেকারি এটা দেখে দাম বাড়িয়ে দেয়। এখন একটি রুটির দাম বেড়ে হয় ২০ টাকা।
এভাবেও টাকার মূল্য কমে যায় এবং দাম বাড়ে।

৫. মজুরি বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি

কর্মীদের বেতন বা মজুরি বাড়ার কারণে উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। কেননা এর ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই অতিরিক্ত খরচ পণ্যের দামে যুক্ত করে দেয়।

ধরা যাক, একটি পোশাক কারখানায় কর্মীরা মাসে ৮ হাজার টাকা বেতন পেতেন। কর্মীদের বেতন বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হলো। এতে কারখানার মোট উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কারখানার মালিক যদি আগের দামে পণ্য বিক্রি করেন, তাহলে মুনাফা থাকবে না। তাই তিনি উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে বাজারে পোশাকসহ নানা পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিকে বলা হয়, মজুরি বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি। তবে যদি বেতনের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের উৎপাদনশীলতাও বাড়ে, তাহলে সমস্যা হয় না। সমস্যা তখনই হয়, যখন বেতন বাড়ে, কিন্তু উৎপাদন বাড়ে না।

এটি কেইনসীয় অর্থনীতির একটি সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে ১৯৫০–৬০-এর দশকে যখন মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা চলছিল, তখন এ ধারণা অর্থনীতিতে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।

মূল্যস্ফীতি কীভাবে পরিমাপ করা হয়

সরকার এখন প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির হার প্রকাশ করে। এ নিয়ে আলোচনা হয়, গণমাধ্যমে নানা ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। হার বেশি হলে আলোচনা-সমালোচনা বেশি হয়। কারণ, মূল্যস্ফীতি খুব বেশি হলে তা অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে।
কিন্তু এই মূল্যস্ফীতির হার কীভাবে পরিমাপ করা হয়? সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলো এটি কীভাবে হিসাব করে? এই মূল্যস্ফীতি মাপার বিভিন্ন উপায় আছে, কিন্তু সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো ভোক্তা মূল্যসূচক বা কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই।
সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিপিআই কী? এটি এমন একটি পদ্ধতি, যা দিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম সময়ের সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করে।

যেমন—

ক. ২০২৪ সালে দর:

• রুটি ৩০ টাকা, দুধ ৪০ টাকা, ডিম ৫০ টাকা, মোমবাতি ১০ টাকা, সিনেমার টিকিট ৫০ টাকা; মোট = ১৮০ টাকা।

খ. ২০২৫ সালে দর:

• রুটি ৩২ টাকা, দুধ ৪২ টাকা, ডিম ৫৫ টাকা, মোমবাতি ১২ টাকা, সিনেমা টিকিট ৫৫; মোট = ২০৭ টাকা।

তাহলে ১ বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এমন হলে সিপিআই ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ধরা হয়।

খুব সহজ উদাহরণ দিলাম। বাস্তবে সিপিআই নির্ণয় করা বেশ জটিল। কেননা অনেক ধরনের পণ্যসেবা বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই উদাহরণ দেওয়া হয়েছে একটি ধারণা দেওয়ার জন্য।

তবে এখানে কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন সিপিআই কম মানেই সবকিছুর দাম আস্তে আস্তে বাড়ছে—এটা ঠিক না।

আবারও উদাহরণ দিচ্ছি—
ক. প্রাথমিক প্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন:

• চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ

• গমের বেড়েছে ৫ শতাংশ

• ডিম ৬ শতাংশ

খ. কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, যেমন:

• মোমবাতি বেড়েছে মাত্র ১.২৫ শতাংশ

• সিনেমাল টিকিট একই আছে

ফলে সিপিআইয়ের গড় বৃদ্ধি কম হলেও মানুষ ‘দাম বেড়ে গেছে’ বলে মনে করবে। কারণ, তারা সবচেয়ে বেশি দরকারি জিনিসের দাম বাড়তে দেখছে। সুতরাং বলা যায়, সিপিআই শুধু একটি গড় হিসাব, সবকিছুর নিখুঁত প্রতিফলন নয়।
বাংলাদেশে সিপিআই যেভাবে নির্ণয় করা হয়

এ কাজ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএস একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভোক্তাদের খরচের ওপর ভিত্তি করে একটি ‘ভোগ্যপণ্যের ঝুড়ি’ তৈরি করে। এ ঝুড়িতে খাদ্য, আবাসন, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রতিটি পণ্যের জন্য একটি ওজন বা ওয়েট নির্ধারণ করা হয়, যা সেই পণ্যের খরচের অনুপাত নির্দেশ করে। বিবিএস শহর ও গ্রামের জন্য দুটি আলাদা ঝুড়ি তৈরি করে। সব মিলিয়ে এক হাজারের বেশি পণ্য এই ঝুড়িতে রাখা হয়।

প্রতি মাসে দেশের ৬৪টি জেলায় ১৫৪টি প্রধান বাজার থেকে ওই ঝুড়িভুক্ত পণ্যের বাজারমূল্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর মূল্যসূচক হিসাব করা হয়। এ জন্য নির্ধারিত ভিত্তি বছর অনুযায়ী, প্রতিটি পণ্যের দাম কতটুকু বেড়েছে, তা হিসাব করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে জার্মানির শিশুরা এভাবেই ডয়েসে মার্ক দিয়ে খেলত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে জার্মানির শিশুরা এভাবেই ডয়েসে মার্ক দিয়ে খেলত

মূল্যস্ফীতি কি খারাপ

যদি মূল্যস্ফীতি জিনিসকে ব্যয়বহুল করে তোলে এবং টাকার মান কমিয়ে দেয়, তাহলে কি আমাদের শূন্য বা ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতির (ডিফ্লেশন) দিকে যাওয়া উচিত?
শূন্য মূল্যস্ফীতি শুনতে ভালো লাগলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ভালো নয়? এবার সেটাই দেখি।

ক. অল্প মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য ভালো

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত ২-৩ শতাংশ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য ঠিক করে। কারণ, অল্প মূল্যস্ফীতি মানুষকে খরচে উৎসাহিত করে। যদি মানুষ বুঝতে পারে, ভবিষ্যতে দাম বাড়বে, তারা এখনই কিনে নেয়। ফলে ব্যবসা বাড়ে, চাকরি তৈরি হয়, অর্থনীতি সচল থাকে।

বিশ্বে প্রথম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বা ইনফ্লেশন টার্গেটিং নীতি অনুসরণ করা শুরু করে নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউজিল্যান্ড ১৯৮৯ সালে সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এরপর ১৯৯০ সালে ব্যাংকটি ঘোষণা দেয় যে তারা বছরে ১ থেকে ৩ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় ও কাঙ্ক্ষিত হিসেবে ধরে নীতিনির্ধারণ করবে।

এর ফলে মুদ্রানীতিতে স্বচ্ছতা, পূর্বানুমানযোগ্য ও জবাবদিহি বাড়ে। এরপর অনেক দেশ এই মডেল অনুসরণ করে। যেমন কানাডা (১৯৯১), যুক্তরাজ্য (১৯৯২), সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়া (১৯৯৩) ইত্যাদি।

খ. ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতি কিছুটা বিপজ্জনক

যখন মুদ্রাস্ফীতি শূন্য শতাংশের নিচে নামে, তখন দাম কমতে থাকে। যা শুনতে ভালো লাগলেও বিপদ ডেকে আনতে পারে। তখন কোম্পানিগুলো লাভ ধরে রাখতে বেতন কমিয়ে দেয়। ফলে লোকজনের হাতে টাকা কম থাকে, আর তারা কিছু কিনতে পারে না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০-এর দশকে যে মহামন্দা ঘটেছিল, তা হয়েছিল এই ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতির কারণেই।

গ. অতি মূল্যস্ফীতি বা হাইপারইনফ্লেশন ভয়াবহ
অতি মূল্যস্ফীতির অর্থ হচ্ছে প্রতি মাসে গড় মূল্য ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ছে। পৃথিবীর অনেক দেশই অতি মূল্যস্ফীতি নিয়ে চরম বিপদে পড়েছিল।

ভেনেজুয়েলা, জিম্বাবুয়ে, জার্মানি ও হাঙ্গেরির মতো দেশ এ অবস্থা দেখেছে। এ সময় সরকার বেশি টাকা ছাপিয়েছে। ফলে মুদ্রার মান হারিয়েছে। একপর্যায়ে মানুষ টাকা রাস্তায় ফেলে দিত। কারণ, তাতে কিছু কেনা যেত না।

জিম্বাবুয়ের জন্য সময়টা ছিল ২০০৭-২০০৮। ২০০৮ সালে জিম্বাবুয়ের মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছিল ৮৯.৭ ট্রিলিয়ন শতাংশ। তখন একটি রুটি কিনতে লাগত ১ বিলিয়ন জিম্বাবুয়ান ডলার। ফলে সরকার ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের নোট ছাপাতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষ মুদ্রা ব্যবহার করত না, বরং বার্টার ট্রেড (পণ্য বিনিময়) করত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানোর কারণে জার্মানিতে অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে। মানুষ টাকা দিয়ে চুলা জ্বালাত। কারণ, তা কয়লার চেয়ে সস্তা ছিল।

হাঙ্গেরির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হাইপারইনফ্লেশন হয় ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে। দাম প্রতিদিন দ্বিগুণ হতো। সরকার ১০০ ট্রিলিয়ন পেঙ্গোর নোট চালু করেছিল। শেষ পর্যন্ত সেই মুদ্রা বাতিল করে ফরিন্ট নামে নতুন মুদ্রা চালু করে, যা এখনো আছে।
তেলের দামে ধস, দুর্নীতি ও উৎপাদনহীন অর্থনীতির কারণে ভেনেজুয়েলায় অতি মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে। ২০১৮ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০,০০০,০০০ শতাংশ। ফলে সরকার নতুন মুদ্রা চালু করেছিল ৫টি শূন্য বাদ দিয়ে।

অতি মূল্যস্ফীতি বা হাইপারইনফ্লেশন
অতি মূল্যস্ফীতি বা হাইপারইনফ্লেশন

মুদ্রাস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়

মুদ্রাস্ফীতি বেশি হলে খারাপ, আর খুব কম হলেও ভালো নয়। তাহলে স্থিতিশীল কীভাবে রাখা হবে। এর দায়িত্বে আছে দুটি পক্ষ। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতিয়ার হচ্ছে মুদ্রানীতি (মনিটরি পলিসি) ও সরকারের হাতে আছে রাজস্ব নীতি (ফিসক্যাল পলিসি)।

ক. সুদহার: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সুদের হার নিয়ন্ত্রণ। সুদের হার মানে হচ্ছে ঋণের জন্য শতাংশ হিসাবে যে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।

• সুদ কম → ঋণ সস্তা → মানুষ বেশি ধার নেয় → খরচ বাড়ে → মূল্যস্ফীতি বাড়ে

• সুদ বেশি → ঋণ ব্যয়বহুল → খরচ কমে → মূল্যস্ফীতি কমে

কিন্তু সুদ বেশি থাকলে অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ে। তাই ভারসাম্য রাখতে হয়।

খ. অর্থ সরবরাহ: সুদহার ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে আছে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ বা ওপেন মার্কেট অপারেশনস।

• সম্প্রসারণমূলক নীতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড কিনে -> ব্যাংকের হাতে বেশি টাকা -> ঋণ বাড়ে -> খরচ বাড়ে → মূল্যস্ফীতি বাড়ে

• সংকোচনমূলক নীতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বন্ড বিক্রি করে -> ব্যাংকের হাতে কম টাকা -> ঋণ কমে -> খরচ কমে → মূল্যস্ফীতি কমে

সরকারের রাজস্ব নীতির মধ্যে আছে কর নির্ধারণ ও সরকারি ব্যয়।

ক. কর নির্ধারণ:

• অর্থ সরবরাহ বেশি থাকলে সরকার কর বাড়ায় → খরচ কমে → মূল্যস্ফীতি কমে

• অর্থ সরবরাহ কম থাকলে কর কমায় → খরচ বাড়ে → মূল্যস্ফীতি বাড়ে

যদিও সরকার খুব একটা কর কমায় না বলেই দেখা যায়।

খ. সরকারি ব্যয়:

সরকার যদি বড় প্রকল্প চালু করে (যেমন সেতু তৈরি), তাহলে:

• ঠিকাদার, কর্মী, দোকানদার → সবাই টাকা পায় → খরচ বাড়ে → মূল্যস্ফীতি বাড়ে

যদি তারা ব্যয় কমিয়ে দেয়, তবে:

• আয় কমে → খরচ কমে → মূল্যস্ফীতি কমে

সরকারি প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার হয়, ফলে এদের প্রভাব অনেক বড়।

মূল্যস্ফীতি থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবেন

এ কথা প্রায়ই শোনা যায়, টাকা জমাও। কিন্তু দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির কারণে সেই টাকা ১০ বছর পর আগের মতো আর কাজ করে না। টাকার মান কমে যায়। এর একটি সমাধান হচ্ছে বিনিয়োগ করা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ক্ষেত্র হচ্ছে সোনা কিনে রাখা। কারণ, সোনার সরবরাহ সীমিত আর চাহিদা বেশি। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সোনার দামও বাড়ে। আবার অনেকে শেয়ারবাজারের স্টক, রিয়েল এস্টেট, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে বেশি লাভ বা মুনাফা পেতে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে ১০টি বিখ্যাত উক্তি

১. মূল্যস্ফীতি ছিনতাইকারীর মতোই হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতোই ভয়ংকর, আর খুনির মতোই প্রাণঘাতী।
—রোনাল্ড রিগান, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট

২. মূল্যস্ফীতি টুথপেস্টের মতো—একবার বের হলে আর টিউবে ফেরানো যায় না।
—কার্ল ওটো প্যোহল, জার্মানির সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান

৩. আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি হয়, কারণ রাজনীতিকেরা খুব আরামে থাকে।
—রোনাল্ড রিগান, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট

৪. মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে সরকার নিঃশব্দে এবং অদৃশ্যভাবে তাদের নাগরিকদের সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আত্মসাৎ করতে পারে।
—জন মেইনার্ড কেইনস, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ

৫. মূল্যস্ফীতি হলো এমন এক কর, যা কোনো আইন ছাড়াই আরোপ করা যায়।
—মিল্টন ফ্রিডম্যান, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ

৬. মূল্যস্ফীতি যখন হয়, তখন সবকিছুর দাম বাড়ে—শুধু আপনার বেতন ছাড়া।
—উইল রজার্স, আমেরিকান রম্যলেখক

৭. মূল্যস্ফীতি হলো এমন অবস্থা, যখন আপনি ১৫ ডলার দেন সেই চুল কাটার জন্য, যা আগে ১০ ডলারে হতো, আর একসময় হতো ৫ ডলারে—যখন আপনার মাথায় চুল ছিল!
—স্যাম ইউইং, আমেরিকান বেসবল খেলোয়াড়

৮. মূল্যস্ফীতি ধনীদের আরও ধনী করে তোলে, আর গরিবদের আরও গরিব।
—অ্যান্ড্রু জ্যাকসন, যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট

৯. সর্বোত্তম ভাষা হলো নীরবতা। আমরা এখন এক ভয়ানক শব্দস্ফীতির সময়ে বাস করছি, যা মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে অনেক ভয়াবহ।
—এদুয়ার্দো গালেয়ানো, উরুগুয়ের লেখক ও সাংবাদিক

১০. যদি আপনি টাকা টয়লেট পেপারের মতো ছাপান, তাহলে একসময় টাকাই টয়লেট পেপার হয়ে যাবে।
—পিটার শিফ, আমেরিকান অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

উপসংহার

মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক অংশ। এটি অনেক কারণে ঘটে—অপ্রত্যাশিত ঘটনা, সরকারি নীতি বা বড় কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা। আমরা এটি পুরোপুরি ঠেকাতেও পারি না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কীভাবে কাজ করে, তা বুঝলে এবং কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয় শিখলে, আপনি আগেই প্রস্তুত থাকতে পারবেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং সরকারকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে।

তথ্য সূত্র:

হোয়াই প্রাইস ওন্ট স্টপ রাইজিং? ইনফ্লেশন এক্সপ্লেইনড: এক্সপ্লেইনস ১০১, হোয়াট

আর ইনফ্লেশন এক্সপেকটেশন্স? হোয়াই ডু দে ম্যাটার?: জেমস লি, টাইলার পাওয়েল, অ্যান্ড ডেভিড ওয়েসেল, ২০২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *