তার একটি নেকলেসের দাম ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ৬১ লাখ ৫০ হাজার। তার একটি ব্যাগের দাম ১০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ১২ লাখ ৩০ হাজার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে আলিশান ফ্ল্যাট। রয়েছে দামি গাড়ি। ওয়াশিংটন ডিসিতে গ্লাস ও স্টিলের তৈরি চারতলা বাড়ি। দুবাই, লন্ডন ও যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বিনিয়োগ।
দুবাইয়ে এমন বিলাসী জীবন যাপনকারী এই নারীর নাম মেহেরীন সারাহ মনসুর। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের মেয়ে। মেহেরীন নিজেকে একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি নিজেকে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, একজন হোটেল ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে এত বিনিয়োগ, বিলাসী জীবনযাপন, এত সম্পদ- এসব অর্থের বৈধ উৎস কোথায়?
মেহেরীন সারাহ মনসুরের এই বিলাসী জীবনযাপন, তার বিনিয়োগ ও ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট। পত্রিকাটির সাংবাদিক টিম লারকিনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে প্রতিবেদনটি। এ ছাড়া এসএসটিভি ডট প্রেস নামের একটি গণমাধ্যমেও মেহেরীন সারাহর বিলাসী জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট পত্রিকার সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে গোপন সম্পদের মালিকদের যে তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল, সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার নাম বাদ দেওয়া হয়। মেহেরীন সারাহ মনসুর তাদের একজন।
প্রসঙ্গত, দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সুবিধাভোগীসহ ৪৬১ জন বাংলাদেশির গোপন সম্পদ রয়েছে দুবাইয়ে।
মেহেরীন সারাহ মনসুরের বিলাসী জীবনযাপনের দিকে একনজর চোখ বোলানো যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টে খুঁজে পাবেন সমুদ্রসৈকতে রোদ পোহানোর বহু চিত্তাকর্ষক ছবি। পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছুতে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আরও খুঁজে পাবেন বেহিসাবি জীবনযাপনের নানা ছবি। তবে তার বাবা নিজেকে এমন একটি পদে অধিষ্ঠিত করেছেন যেখানে তিনি দুর্নীতি এবং বেহিসাবি খরচের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন সময় পার করছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সুদের হারও ঊর্ধ্বমুখী। ১২ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশের মানুষ এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তবে তাদের মধ্যে দ্রুত একটি প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। তা হলো দেশের অর্থনীতি যেখানে কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখে, সেখানে এই কঠিন পরিস্থিতিতে আহসান এইচ মনসুরের মেয়ে কীভাবে বিদেশে এমন বিলাসী জীবনযাপন করছেন?
আরও প্রশ্ন উঠতে পারে, আহসান এইচ মনসুর ওয়াশিংটনে কাচ আর স্টিলের চারতলা ‘ফ্রেম হাউসে’ নিজেকে কীভাবে আরাম-আয়েশে রাখেন, আর অন্যদের কোনো মতে টিকে থাকার অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়?
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেহেরীন সারাহ মনসুর সেই ছোটবেলা থেকেই বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তিনি ওয়াশিংটনের পাশেই অভিজাত এলাকায় থেকে পড়ালেখা করেছেন। ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভ্রমণে অভ্যস্ত। একবার তিনি একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ছবি হয়েছিলেন। এলিট শ্রেণি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে প্রাণান্তকর চেষ্টা রয়েছে তার। দৃশ্যমান বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও বিলাসী জীবনযাপন অব্যাহত রয়েছে তার।
জীবনের শুরুতে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন মেহেরীন। ব্লগার, ফ্যাশন ডিজাইনার, জুয়েলারি ব্যবসায়ী- কি না হওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। ২০ বছর বয়সের আগে ঢাকায় তিনি নিজেকে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হিসেবেও দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কম মূল্যে সবার জন্য তিনি খাবারের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গুলশানের হর্স অ্যান্ড হর্স রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ জব্দ করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ওই অভিযানের পর পরই মেয়ের পক্ষে সরব হয়েছিলেন আহসান এইচ মনসুর।
অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব খাটিয়ে মেয়েকে মামলা থেকে বাদ দিয়েছেন ‘পরিচ্ছন্ন ইমেজের’ আহসান এইচ মনসুর।
মেহেরীন সারাহ মনসুর এখন বসবাস করছেন দুবাইয়ে। তার জীবনযাপনের পরতে পরতে বিত্ত-ভৈববের ছোঁয়া। তাকে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন ফ্যাশন শোতে। দামি গাড়ি চালান। কয়েক হাজার পাউন্ড মূল্যের ঘড়ি পরেন। এসবের বেশির ভাগই তার বাবার দেওয়া উপহার। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে তুলে ধরলেও তিনি আসলে কী ব্যবসা করেন, সে ব্যাপারে তার প্রোফাইলে কোনো তথ্য দেননি।
মেহেরীনের একটি উদ্যোগ ছিল ‘ওয়াচার্স ফাউন্ডেশন’। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়া হতো এই ফাউন্ডেশন থেকে। কিন্তু ইদানীং এই ফাউন্ডেশনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ২০২৩ সাল থেকে এর ফেসবুক পেজটিও নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এর ওয়েবসাইটে লেখা আছে ‘শিগগির উদ্বোধন হবে’। ২০২১ সালের মে থেকেই তিনি নিজেকে ফাউন্ডেশন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে টিম লারকিন আরও বলেছেন, ডেইলি স্টার পত্রিকা অনেকের বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে প্রতিবেদন করে থাকে। কিন্তু মেহেরীন সারা মনসুরের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিলাসী জীবন নিয়ে কোনো প্রতিবেদন করেনি পত্রিকাটি। সম্ভবত অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেছে। তবে অনেকের দৃষ্টিতে একটি বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে যে, একদিকে মেয়ে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন, আর তার বাবা দেশের শীর্ষ ব্যাংকার হয়ে সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে নিয়ে গেছেন। মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ে গেছেন দুই অঙ্কের কোটায়।