আউলিয়া বেগম আলো : যশোরে কৃষি ও কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের রূপকার কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প-এর প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ সম্প্রতি বলেন, বংলাদেশে কৃষি খাতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আগামী দুই দশক এ খাত দ্রুতগতির রূপান্তরধর্মী এক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবে, যে লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্র থাকবে ‘উত্তম কৃষিচর্চা’। যার ধারাবাহিকতায় যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ এর মধ্যে। এছাড়াও যশোরের সার্বিক কৃষি ও কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটবে প্রকল্পটি।
সরকারের সময়োগযোগী নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ, কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি কৃষকের পরিশ্রম এই বৈপ্লবিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। দেশের ক্রমহ্রাসমান আবাদী জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যায় পুষ্টি চাহিদা পূরণ, বিশ^ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং মহামারি করোনা অভিঘাত পরবর্তী দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি নিরসনে খোরপোশ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর আগামীর কৃষির অন্যতম প্রধান চ্যলেঞ্জ।
এ চ্যলেঞ্জ মোকাবেলা ও চলমান কৃষি উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ এবং কৃষি পণ্যের আধুনিক পর্যায় বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কৃষি পেশাকে লাভজনক করার কোন বিকল্প নেই।
যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে কৃষককে লাভবান করার পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাস ও পুষ্টিমান নিশ্চিতকরণ, কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ কৌশলের টেকসই উন্নয়ন, বাণিজ্যিক কৃষিতে কৃষকের দক্ষতা, বৃদ্ধি, কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, তরুণ উদ্যোক্তাদের কৃষির মূলধারায় অন্তর্ভূক্তকরণ এবং বিশ^ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কৌশলের কথা এখনই বিবেচনায় আনা অপরিহার্য। যশোরের এ প্রকল্পের এসব বিষয় অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় প্রতিটি ব্লক ৩০ জন কৃষকদের নিয়ে ক্ষুদ্র কৃষক দলে গঠন করা হবে এবং প্রতি ৩টি ক্ষুদ্র কৃষক দলকে নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়নে ১টি করে মোট ৩১৮টি কৃষক সংগঠন তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় যশোর অঞ্চলের ৩১টি উপজেলায় মোট ২৮ হাজার ৬২০ জন কৃষককে পর্যায়ক্রমে আধুনিক ব্যয় সাশ্রয়ী ও নিরাপদ কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
বাণিজ্যিক কৃষির সম্প্রসারণের জন্য আলাদা করে প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ৮০০ জন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে কৃষির মূল ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। প্রকল্প হতে প্রতিটি উপজেলায় ২টি করে মোট ৬২টি বহুমূখী কৃষক কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে গ্রামীণ কৃষকরা তাদের চাহিদা অনুসারে মান সম্পন্ন চারা উৎপাদন থেকে শুরু করে তাদের উৎপাদিত ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সকল প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে।
এছাড়া প্রকল্পের সামগ্রীক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকল্পের অধিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিসিএস কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তাবৃন্দের নিকট হতে আধুনিক যুগোপযোগী প্রযুক্তি বিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ একান্ত প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য পাঠ পরিকল্পনা ও পাঠ সহায়িকা সংযুক্তি সম্বলিত এ প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সাথে কৃষি তথ্য আদান-প্রদানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করা হচ্ছে।
প্রকল্প কর্তৃক ডিএই কর্মকর্তাদের নিরাপদ উচ্চমূল্যের ফসল (সবজি, মসলা, ফল ও ঔষধি) উৎপাদন কৌশল, উত্তম কৃষি চর্চা, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, ব্যয়সাশ্রয়ী ও ফলপ্রদ পানি ব্যবস্থাপনা, আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার সংযোগ স্থাপন এবং জেন্ডার বিষয়ে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকার আওতাধীন উপজেলা সমূহ সংশ্লিষ্ট ব্লককের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের (এসএএও) মাধ্যমে এবং পাশর্^বর্তী ব্লককের এসএএও-এর সহযোগিতায় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রতিটি উপজেলায় বব্লকসমূহে উচ্চমূল্য ফসল চাষে সামর্থ্য এবং আগ্রহী এমন ৩০ জন কৃষকের সমন্বয়ে একটি করে মোট ৯৫৪টি ক্ষদ্র কৃষক দল গঠন করা হবে এবং উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে গঠিত ৩টি ক্ষুদ্র কৃষক দল নিয়ে একটি করে মোট ৩১৮টি কৃষক সংগঠনে তৈরী করা হচ্ছে। উক্ত সংগঠনভূক্ত কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার প্রতিটি কৃষক সংঘের আওতায় ১০ হেক্টর করে মোট ৩ হাজার ১৮০ হেক্টর জমি উত্তর কৃষি চর্চা নিরাপদ উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদনের আওতায় আনা হচ্ছে।
প্রকল্পের তৈরিকৃত মাস্টার ট্রেইনাররা এসএএও-দের নিরাপদ উচ্চমূল্য ফসল উৎপাদন কৌশল, উত্তম কৃষি চর্চা, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, মাটির স্বাস্থ্য সংরকক্ষণ, ব্যয়সাশ্রয়ী ও ফলপ্রদ পানি ব্যবস্থাপনা, আইসিটি কৌশলের মাধ্যমে আধুনিক বাজার সংযোগ স্থাপন এবং জেন্ডার বিষয়ে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ (টিওটি) প্রদান করছেন। টিওটি প্রাপ্তরা নির্বাচিত কৃষক-কৃষাণীদের উক্ত বিষয় সমূহে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সবজি, ফল, মসলা, ঔষধি ফসল চাষ এবং কৃষি প্রযুক্তি গ্রাম ও জৈব সার উৎপাদন প্রদর্শনীসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে প্রকল্প কর্তৃক আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাজার সংযোগ স্থাপন বিষয়ে গ্রামীণ কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য কোন মধ্যস্বত্তাভোগী ব্যতিত সরাসরি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের পাইকারি ক্রেতার নিকট বিক্রয় করে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পারবে।
এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে যশোর কৃষি অঞ্চলে ৬২টি বহুমুখী কৃষক কেন্দ্র স্থাপন করা কাজ চলছে। উক্ত বহুমুখী কৃষক কেন্দ্র ব্যয়সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, পলি হাউজে রোগ মুক্ত চারা উৎপাদন প্রযুক্তি ও বজ্র নিরোধক প্রযুক্তি সংযুক্ত থাকছে। যার ফলে উক্ত কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় ৬২০ হেক্টর জমি ব্যয়সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। বজ্র সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মাঠে কর্মরত কৃষকরা এই কেন্দ্র আশ্রয় নিয়ে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বাভাকি সময় এখানে বিশ্রাম নিতে পারবে।
বহুমুখী কৃষক কেন্দ্রে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন: সর্টিং, গ্রেডিং, ওয়াশিং, ড্রাইং, প্যাকেজিং ইত্যাদি কার্য সম্পাদনের জন্য পৃথক পৃথক চেম্বার থাকবে। যার ফলে সারা বছর এই কেন্দ্রটি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থার করবে।
প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ৮০০ তরুণ কৃষি উদ্যোক্ত সৃষ্টি এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে। এই সকল উদ্যোক্তাদের মধ্য হতে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের যন্ত্রপাতি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিক বাণিজ্যিকীকরণ কার্যক্রমকে আরও ত্বরান্বিত করা হবে। উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে অবহিতকরণ পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন কর্মশালা, কৃষি প্রযুক্তি মেলা, কৃষক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকার প্রতিটি জেলার উপ-পরিচালকের কার্যালয় ও অত্র প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়র মাধ্যমে জেলায় অবহিতকরণ পরিকরল্পনা ও মূল্যায়ন কর্মশালা এবং জাতীয় অবহিতকরণ পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন কর্মশালা, কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, কৃষি উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিষয় উন্নত ধারণা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের বিষয়ে ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
যশোরের ২৮ হাজার ৬২০ জন কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় উচ্চমূল্যের নিরাপদ ফসল উৎপাদন ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া ব্যয়সাশ্রয়ী ও ফলপ্রদ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চমূল্য ফসলের উৎপাদনশীলতা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় ২০ শতাংশ হ্রাস করে কৃষিকে লাভজনক করা হবে। এছাড়া ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চমূল্য ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ১৫% হ্রাস করা টার্গেট রয়েছে।
কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ ১৪ আগস্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ তারিখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের “যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প”-এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এর পূর্বে তিনি এ কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বিসিএস (কৃষি) ক্যাডারের ২৯তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০১১ সালের ১ আগস্ট বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। পরে দেড় বছরের মাথায় বদলি হয়ে যোগদান করেন খুলনার দৌলতপুর মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসে। সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালের ২৭ মে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
শিক্ষা জীবনে রমেশ চন্দ্র ঘোষ সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি, ২০০১ সালে কলারোয়া সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এইচএসসি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ২০০৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগ থেকে তিনি এমএস ডিগ্রি লাভ করেন। রমেশ চন্দ্র ঘোষ সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামের রাধাপদ ঘোষ এবং স্মৃতি রাণী ঘোষের সন্তান।
পারিবারিক জীবনে রমেশ চন্দ্র ঘোষ দুই কন্যা সন্তানের জনক। কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় স্বীকৃতিস্বরূপ “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৪” পুরস্কারে ভূষিত হন কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ।