লিভার মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, যা শরীরের প্রাকৃতিক ‘ডিটক্স মেশিন’ হিসেবে কাজ করে। এটি রক্ত থেকে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে বের করে দেয়, ওষুধ এবং অ্যালকোহলের বিপাক ঘটায়, এবং হজমে সহায়তা করে পিত্তরস উৎপাদনের মাধ্যমে। এ ছাড়াও, এটি ভিটামিন ও খনিজ সংরক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় সহায়তা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে।
তবে বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত প্রসেসড খাবার খাওয়া, ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবের কারণে লিভারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলো লিভার ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস, এমনকি লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
লিভার ভালো রাখতে তাই কিছু নির্দিষ্ট পানীয় ও খাবার নিয়মিত গ্রহণ করা যেতে পারে, যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে লিভারকে পরিষ্কার ও কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। নিচে তেমন কিছু পানীয় ও খাবারের কথা তুলে ধরা হলো:
গ্রিন টি
গ্রিন টিতে থাকে ক্যাটেচিন নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা লিভারের চর্বি বিপাক উন্নত করে এবং প্রদাহ হ্রাস করে। এটি কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, ফলে লিভারের উপর চাপ কমে।
পান করার উপায়:
১ কাপ ফুটন্ত পানিতে ১টি গ্রিন টি ব্যাগ দিন। ৩–৪ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। চাইলে সামান্য লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে পান করুন। দিনে ১–২ কাপ পান করা যেতে পারে।
ব্ল্যাক কফি
ব্ল্যাক কফিতে থাকা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড লিভারের চর্বি কমাতে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাব রাখতে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি উন্নত করতেও সহায়তা করে, যা নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ প্রতিরোধে কার্যকর।
পান করার উপায়:
১ কাপ ফুটন্ত পানিতে ১–২ চা চামচ ইনস্ট্যান্ট কফি গুলে পান করুন। চিনিমুক্ত রাখা ভালো। দিনে ১–২ কাপই যথেষ্ট।
ব্ল্যাক টি
ব্ল্যাক টিতে থাকা থিয়াফ্লাভিন ও থিয়ারুবিজিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারের কোষগুলিকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। এটি লিভারের ফ্যাট জমা কমাতে সহায়তা করে এবং রক্তনালীর কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
পান করার উপায়:
১ কাপ পানি ফুটিয়ে ১ চা চামচ চা পাতা যোগ করে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে ছেঁকে নিন। গরম গরম পান করুন, দুধ বা চিনি না দেওয়াই উত্তম।
বিটরুটের রস
বিটরুটে রয়েছে বিটালাইনস ও নাইট্রেটস, যা লিভারের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং ডিটক্স প্রক্রিয়া জোরদার করে। এটি লিভারের প্রদাহ হ্রাসেও কার্যকর।
পান করার উপায়:
২টি বিটরুট খোসা ছাড়িয়ে ছোট টুকরো করে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করুন। ছেঁকে তাতে সামান্য লেবুর রস, লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে পান করুন। সকালে খালি পেটে পান করলে ভালো ফল পাবেন।
ডালিমের জুস
ডালিমে থাকে পুনিকাল্যাজিন, একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা লিভারের কোষকে সুরক্ষা দেয় এবং ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি কমায়। এটি রক্তপ্রবাহ উন্নত করে, ফলে লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়ে।
পান করার উপায়:
২টি মাঝারি আকারের ডালিমের বীজ ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে ছেঁকে নিন। চাইলে সামান্য ব্ল্যাক সল্ট মিশিয়ে পান করুন।
অলিভ অয়েল
জলপাই তেল লিভারের জন্য আরেকটি স্বাস্থ্যকর খাবার কারণ এটি লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গের উপর অনেক উপকারী প্রভাব ফেলে। অলিভ অয়েল লিভারের এনজাইমের মাত্রা উন্নত করতে সাহায্য করে যা লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে। এটি লিভারে রক্তের প্রবাহ উন্নত করতেও সাহায্য করে। এটি লিভারকে রোগ থেকে রক্ষা করতেও এবং হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
সবুজ শাক
পালং শাক, কালে, কলার্ড শাক ইত্যাদি পাতাযুক্ত সবুজ শাক লিভারের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এসব শাকে ভিটামিন C, ভিটামিন E এবং বিটা-ক্যারোটিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং লিভারের কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে।
এছাড়া, এসব শাকে ক্লোরোফিল থাকে, যা শরীর থেকে টক্সিন এবং ভারী ধাতু অপসারণে সহায়তা করে, ফলে লিভারের ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হয়।
সবুজ শাকে থাকা উচ্চমাত্রার ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া, এতে থাকা গ্লুকোসিনোলেট নামক প্রাকৃতিক যৌগ লিভারের ডিটক্স এনজাইমগুলোর কার্যকারিতা বাড়ায়, যা লিভারের সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লিভার সুস্থ রাখার জন্য আরও কিছু উপায়:
-পর্যাপ্ত পানি পান করুন (দিনে অন্তত ৮ গ্লাস)
-উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং প্রসেসড খাবার এড়িয়ে চলুন
-নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন
-অ্যালকোহল সেবন পরিহার করুন
-পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন