জনতার কণ্ঠ রিপোর্ট: গোপালগঞ্জ শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে বিল বাঘিয়া। যতদূর চোখ যায় থইথই পানি। কোটালীপাড়ার কলাবাড়ী ইউনিয়নের রামনগর গ্রামটি বছরের বেশির ভাগ সময় থাকত পানির নিচে। একটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি খানিকটা দূরে। প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে এই গ্রামের বাসিন্দাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পা রাখতে হতো নৌকায়। নৌকা এসে ভিড়ত রাজৈর-কোটালীপাড়া সড়কে। এখন বদলে গেছে রামনগর। মূল সড়কে উঠতে কাউকে আর নৌকায় ভর করতে হয় না। বিলের বুক চিরে বানানো হয়েছে সড়ক; যেখানে খুব সহজে তিন চাকার বাহন চলাচল করতে পারে।
শুধু রামনগর নয়, কলাবাড়ী ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের গল্প ঠিক এমনই। বাড়িগুলো যেমন ছিল বিচ্ছিন্ন, গ্রামগুলোও ছিল আলাদা। গত বছরও এক গ্রামের মানুষকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকায় উঠতে হতো। এখন সংযোগ ঘটেছে গ্রামের সঙ্গে গ্রামের। একের সঙ্গে অন্যের মেলবন্ধন হয়েছে। দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলেছে অন্তত ৩০ হাজার বাসিন্দার। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যও আর বাজারে তুলতে ভোগান্তি নেই।
গতকাল শনিবার বিকেল ৫টা। বিল বাঘিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কৃষক অনিমেষ হালদারের সঙ্গে। গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়নের বিষয়ে বলতে গিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত এই কৃষক বলেন, ‘এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাইতে রাস্তা হইবে, এইডা আমরা স্বপ্নেও ভাবি নাই। শেখের বেটি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আমাগো ভাগ্য খুইলগা দিছে। আমাগো বাপ-দাদারা এসব উন্নয়ন দেখে যাইতে পারে নাই। আমরাও অনেক কষ্ট করছি। এহোন শান্তির দিন শুরু। এবার অন্তত শান্তিতে মরতে পারব।’
কোটালীপাড়ায় গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অভাবনীয় উন্নয়নের চিত্র। আর এসব উন্নয়নের জন্য এলাকার মানুষ মনে-প্রাণে কৃতজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তরুণ থেকে বৃদ্ধ—সবাই একবাক্যে উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যার নাম। স্থানীয় লোকজনের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করেন ‘শেখের বেটি’, আবার কেউ বলেন ‘আমাগো হাসিনা’। কোটালীপাড়ার মানুষ শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কাউকে নির্বাচিত করেননি গোপালগঞ্জ-৩ আসনে। সুযোগ পেয়ে প্রতিদানও দিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর আলোকিত হতে শুরু করে কোটালীপাড়ার ভাগ্যরজনী।
তবে কিছু ঘাটতির কথাও শোনা গেল এলাকাবাসীর কথায়। অনেকে তুলেছেন কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়নের বিপরীতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দারিদ্র্য অনেকটাই বিদ্যমান। শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিপরীতে কর্মসংস্থানের অভাব অনুভব করে তারা। পাট চাষি ধন্য বৈরাগী অনেক কষ্টে শিক্ষিত করছেন ছেলে অপু বৈরাগীকে। মাদারীপুরের নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়ছেন অপু। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান না থাকায় বাবার সঙ্গে চাষাবাদে সহায়তা করেন তিনি।
ধন্য বৈরাগী বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেকে শিক্ষিত করছি। স্বপ্ন দেখি, ছেলে একদিন অনেক ভালো চাকরি করে আমাদের নাম আলোকিত করবে। কিন্তু এখানে তো চাকরির কোনো সুযোগ নেই। যেতে হবে ঢাকায়। এলাকায় কর্মক্ষেত্র থাকলে একসঙ্গে বাকি জীবন কাটাতে পারতাম।’ অপুর কণ্ঠেও একই সুর। তাঁর স্বপ্ন এলাকায় থেকেই একটি ভালো চাকরি। এ জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরির দাবি তাঁর মতো অনেক শিক্ষার্থীর।
এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপুদের স্বপ্ন পূরণের একটি ক্ষেত্র এরই মধ্যে প্রস্তুত। রাধাগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর মৌজায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালে মাঠ জরিপও সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত এলাকায় জমি বেচাকেনায়ও সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের কাজ থমকে যায় কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলই হতে পারে স্থানীয় শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের স্বপ্ন পূরণের বড় ক্ষেত্র।
এলাকা ঘুরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় এরই মধ্যে অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে কোটালীপাড়ায়। এর মধ্যে বিশেষ দৃশ্যমান হলো অবকাঠামো নির্মাণ। দেখা গেছে চোখ-ধাঁধানো একেকটি ভবন। পরিকল্পিত পৌর মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে চারতলা বিশাল ভবনে রয়েছে নানা পণ্যের দোকানপাট। পাশেই আছে সাজানো-গোছানো কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের সমাহার। পাড়কোণা এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে বাস টার্মিনাল। ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রূপান্তর করা হয়েছে ১০০ শয্যায়। উপজেলা পরিষদ, থানা ও পৌরসভার জন্য নির্মিত হয়েছে সুবিশাল আধুনিক ভবন; আছে আধুনিক মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন।
স্বপ্নের ভুবনে ওরা : একসময় কিছুই ছিল না—না মাথা গোঁজার ঠাঁই, না খেলার মাঠ। সেখান থেকে স্বপ্নের ভুবনে ৩০টি পরিবার। তারা পেয়েছে নির্ভরতার ঠিকানা। শুধু বাসস্থানই নয়, আছে শিশুদের জন্য খেলার ব্যবস্থা। মনোবিকাশের জন্য আছে পাঠাগার। কোটালীপাড়ার দেবগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভেতরে ঘুরে মনে হলো, এ যেন একটুকরো শান্তির আশ্রম।
ষাটোর্ধ্ব আমিরুল বানুর কিছুই নেই। দুই ছেলে, নাতি-নাতনিসহ অথই সাগরে ভাসছিলেন বিধবা এই নারী। মহুয়ার কাছে এক আত্মীয়ের জমিতে ঝুপড়ি ঘরে দিন কাটাচ্ছিলেন। দেবগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুটি ঘর পেয়ে এখন অনেকটা চিন্তামুক্ত তিনি। দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে রোজগার করেন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে এখন সুখের দিন আমিরুল বানুর।
ভূমিহীন এস্কেন্দার শেখ-নাজমা বেগম দম্পতিরও একই অবস্থা ছিল। সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে-ফিরে অতিকষ্টে কাটছিল জীবন। এখন তাঁদের ঠিকানা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২১ নম্বর ঘর। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, সামনে পাশাপাশি দুটি রুম। ভেতরে রান্নাঘরে একটি চৌকি পেতে সেটিকে থাকার ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। পাশেই টিনের চালা দিয়ে রান্নাঘর বানিয়েছেন। মূল ঘরের সঙ্গে আছে লাগোয়া শৌচাগারও।
এস্কেন্দার বলেন, ‘খুবই ভালো আছি এখানে। যে জীবন পার করেছি, সেটি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এই বৃদ্ধ বয়সে শেখ হাসিনা আমাদের থাকার ঘর দিয়েছেন, এটি অনেক বড় পাওয়া। এখন মরলেও শান্তি পাব যে সন্তানদের অন্তত রাস্তায় থাকতে হচ্ছে না।’
পাঠাগারে ঢুকে দেখা যায়, দুই পাশের বুকশেলফে থরে-থরে সাজানো নানা রকমের বই। একটি টেবিল ঘিরে চারপাশে অনেক চেয়ার। ছড়ার বই খুলে চোখ বুলাচ্ছিল সাকিবুল ইসলাম। দেবগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল গত বছর। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে স্কুলটাই চেনা হয়ে ওঠেনি সাকিবুলের। এখন এই পাঠাগারই তার কাছে ‘স্কুল’। খেলাধুলার পাশাপাশি বোন জান্নাতি খানমের সঙ্গে পাঠাগারে নিয়মিত ছড়া পড়ে এই খুদে পাঠক। জান্নাতি পড়ে একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে।
দক্ষিণাঞ্চলের বৈষম্য রুখবে বাপার্ড : গোপালগঞ্জ-পয়সারহাট সড়কের পাশে চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন ও সুবিশাল তিনটি ভবন। ঘাঘর নদীর তীরে এই ভবনগুলো গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বাপার্ড) উন্নয়নে। পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুবিধা নিশ্চিত করতে এ প্রকল্প হাতে নেয় শেখ হাসিনা সরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকারি ও বেসরকারি খাতে মানবসম্পদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। প্রায় ৩৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি এখন শেষ দিকে। প্রকল্পের আওতায় আধুনিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সুবিধা সমন্বিত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন।
প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মো. মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নানা সাফল্যের অংশ এটি। মূলত প্রায়োগিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের আঞ্চলিক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিরসন করবে। প্রকল্পটির আওতায় মূল কাজগুলোর মধ্যে প্রায় ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন ও ১০ তলা হোস্টেল ভবন নির্মাণ, ছয়তলা অফিসার্স কোয়ার্টার ও ছয়তলা স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ