জনতার কণ্ঠ স্টাফ রিপোর্টার : দুধের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো এর ক্যালসিয়াম। মানুষের হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য এর ভূমিকা অনবদ্য। আমাদের চলাফেরায় তাই দুধের ভূমিকা অনন্য। সব বয়সের মানুষের জন্য চাই দুধ। সব ধরনের পুষ্টি উপাদানই আমরা দুধ থেকে পেতে পারি।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার দুধ কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। দোকানি, উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে বেড়ে গেছে দুধের উৎপাদন খরচ। যদিও দেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে। মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা নিয়ে খোদ সরকারের একাধিক দপ্তরের মধ্যে উপাত্তের ভিন্নতা সত্ত্বেও দেখা যায়, দেশের মানুষ এখনো প্রয়োজনের তুলনায় কম দুধ পান করে। তাঁরা খাবারের তালিকা থেকে যেভাবে দুধ বাদ দিচ্ছেন, তাতে জনস্বাস্থ্য আরও ক্ষতির মুখে পড়বে বলেই মনে করেন পুষ্টিবিদেরা। এ পরিস্থিতিতে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘পরিবেশ, পুষ্টি ও আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে টেকসই ডেইরি খাত।’ দুগ্ধ খাতের কার্যক্রম বাড়াতে ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) উদ্যোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, একজন মানুষকে গড়ে দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের দুধের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, দেশে বার্ষিক দুধের চাহিদা ১৫৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। উৎপাদন হয় ১১৯ লাখ মেট্রিক টনের বেশি পরিমাণ দুধ।
একজন মানুষকে গড়ে দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের দুধের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের বেশি।
দেশের দুধের প্রায় ৬৫ শতাংশের সরবরাহকারী খামারিরা। তাঁদের কাছ থেকে দুধ নিয়ে সরবরাহ করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিপণনকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উৎপাদন) মো. মজিবর রহমান সর্বশেষ হিসাব দিয়ে বলেন, দেশে মাথাপিছু প্রাপ্য দুধের পরিমাণ ১৯৩ মিলিলিটারের বেশি।
সরকারের এ দপ্তরের হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের গরমিল যথেষ্ট। বিবিএসের ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের পরিমাণ ২৭ গ্রামের কিছু বেশি।
বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল নিউট্রিশন বিভাগের একাধিক শিক্ষকের জোট ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন)। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প। এই জোট জার্মানিভিত্তিক আইএফসিএন-ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের সঙ্গে কাজ করে। দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম, বৈশ্বিক বাজার, ভোক্তা, উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করা।
অ্যানিমেল নিউট্রিশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও আইডিআরএনের পরিচালক মোহাম্মদ মহি উদ্দিন দুধপান পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের ডেইরি খাত এখন এক কঠিন সময় পার করছে। ডেইরি উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ’
আইডিআরএন ও আইএফসিএন-ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের তথ্য অনুসারে, বৈশ্বিকভাবে গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভোক্তাপর্যায়ে দুধের দাম বেড়েছে প্রায় ১১ ভাগ। খামার পর্যায়ে এ মূল্য বেড়েছে ২ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশে গোখাদ্যের পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গোখাদ্যের দাম বৈশ্বিক দামের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি।
এভাবে দুধের দাম বেড়ে যেভাবে বিক্রি কমেছে, তাতে সার্বিকভাবে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে দুধের প্রাপ্যতা অপেক্ষাকৃত কম।’
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ পরিবার দুধের পুষ্টির জন্য গুঁড়া দুধের ওপর নির্ভর করছে। গত তিন বছরে এই চাহিদা প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে। তারপরও এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের ভেতর দুধ খাবার পরিমাণ খুবই কম।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে গুঁড়া দুধের দাম ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। এটি গত প্রায় ১২ বছরের ভেতর সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে দুধ বাজারজাতকরণের জন্য আনুষঙ্গিক খরচ যেমন জাহাজভাড়া, প্যাকেজিং খরচ ইত্যাদিও ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
গুঁড়া দুধ আমদানির বড় অংশই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বন্দর দিয়ে আমদানির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১ লাখ ১ হাজার টন গুঁড়া দুধ আমদানি হয়। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৯৩ হাজার টন।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ডানো ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠান ডেনমার্কের কোম্পানি আরলা ফুডস বাংলাদেশের হেড অব মার্কেটিং গালীব বিন মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুধের মূল্য বৃদ্ধি এ ব্যবসাকে চাপের মধ্যে ফেলেছে। তবে এত খরচ বৃদ্ধি সত্ত্বেও আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি দুধকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে। আমরা দুধের প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষকে জানানোর জন্য ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছি, যার মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী হাটবাজার, তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় ২৬ লাখের মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছেছি।’
দুগ্ধশিল্পের প্রসারে প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে গালীব বিন মোহাম্মদ বলেন, ‘দেশের স্থানীয় দুধের উৎপাদন এবং গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি আমরা প্রাইভেট সেক্টরে দেশের অন্যতম বড় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান “প্রাণ ডেইরি”র সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। যেখানে আমরা ইউরোপে আমাদের দীর্ঘ দেড় শ বছরের খামার ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করব। আমরা চাই, বাংলাদেশের মানুষ ভালো দুধের পুষ্টি পাক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘দুধের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো এর ক্যালসিয়াম। মানুষের হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য এর ভূমিকা অনবদ্য। আমাদের চলাফেরায় তাই দুধের ভূমিকা অনন্য।’
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক নানা দিকে উন্নতি করলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে। দুধের মতো পুষ্টির এই উপাদানের প্রসার কমে গেলে সার্বিক উন্নয়নে তা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পুষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের এক নীরব পিছু হাঁটা শুরু হয়েছে। এর লক্ষণ বোঝা যায় দুধের প্রাপ্যতা কমার এই প্রবণতার মাধ্যমে। ক্ষুধা কমলেও পুষ্টির প্রাপ্যতা আমাদের কমই ছিল। তবে সে ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হচ্ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এ সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছে।’