সমন্বিত চিকিৎসার অভাব, বাড়ছে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যুহার

লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের উত্তর বালাপাড়া গ্রামে সুনীল চন্দ্র শীল গত ১৩ জুন রাতে বাড়ির আঙিনায় সর্পদংশনের শিকার হন। পরে স্বজনরা তাঁকে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। সুনীলের মামা সুকুমার চন্দ্র শীল অভিযোগ করেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ অ্যান্টিভেনম দিতে পারেনি।

এ কারণে আমার ভাগ্নে মারা যায়।’ জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আলী রাজিব মো. নাসের বলেন, সরকারিভাবে হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম শেষ হয়ে গেছে। রোগীর স্বজনদের বাইরে থেকে সেটি কিনে আনার জন্য বলা হয়। তারপর রোগীর শরীরে তা প্রয়োগ করতে হয়।

সুনীলের ক্ষেত্রেও তা-ই করতে হয়েছে। বাইরের ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিভেনম নিয়ে আসতে আসতেই সারা শরীরে বিষক্রিয়া হলে সে মারা যায়। লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে গেলে রোগীদের অ্যান্টিভেনম দেওয়া হচ্ছে না।

জানা গেছে, শুধু লালমনিরহাট নয়, দেশের বেশির ভাগ জেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোর কোথাও অ্যান্টিভেনম না থাকা, কোথাও থাকলেও তা ব্যবহারে চিকিৎসকদের অনীহা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অভাব, রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বিলম্ব, সর্বোপরি সমন্বিত চিকিৎসার অভাবে সাপে কাটা রোগীর বড় অংশই মারা যাচ্ছে।

রোগীকে সরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পরও বাইরে থেকে অ্যান্টিভেনম সংগ্রহ করতে বলা হয় রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে জেলার বড় হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তাতে সময়ক্ষেপণেও সর্প দংশনে আহত রোগীরা মারা যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে, সাপের কামড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ জনের মৃত্যু হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের কামড়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয় সমন্বিত চিকিৎসার অভাব ও সময়ক্ষেপণে। দ্রুত চিকিৎসা নিলে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রোগী বাঁচানো সম্ভব। ২০২৪ সালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জন রোগীর তথ্য রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এর মধ্যে মারা যায় ১১৮ জন। এসব রোগীর বেশির ভাগই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে গেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব সাপ দিবস। সাপ দিবসের উদ্দেশ্য হলো সাপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক সত্য দিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন ভুল ধারণা ভেঙে প্রাণীটির সঙ্গে সহাবস্থানকে উৎসাহিত করা। প্রতিবছর ১৬ জুলাই এই দিবস পালিত হয়।

অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, বছরে দুটি পিক দেখা যায়। একটি হলো বর্ষায়। এ সময় সাপ ও মানুষের সংস্পর্শ বেড়ে যায়। মানুষ উত্ত্যক্ত করলে সাপ কামড়ায়। জুন, জুলাই ও আগস্টে এ ধরনের ঘটনা বেশি হয়। সাপ কামড়ায় সাপের প্রজননের সময় অক্টোবর মাসেও। সব উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে সমন্বিত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। অন্তত সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ২৪ ঘণ্টা সাপের কামড়ের রোগীর জন্য সমন্বিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে মৃত্যু কমানো সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, সাপের কামড়ের শিকার সব রোগী যদি চিকিৎসকের কাছে যায় তাহলে বছরে অন্তত ৭০ হাজার ডোজ অ্যান্টিভেনম দরকার। কিন্তু ২৫ হাজারের বেশি কখনো ব্যবহৃত হয় না। কারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য আসে না। চাহিদা দিয়ে অ্যান্টিভেনম পায়নি এমন কোনো ঘটনা নেই। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ১০ হাজার ভায়াল কিনেছে, আর ১০ হাজার ভায়াল দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্বশেষ গত দুই মাসে আড়াই হাজার ভায়াল সরবরাহ করা হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৬৫০ ভায়াল।

গত ১৫ জুন মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গিবাড়ীতে সাপে কাটার পর চায়না মণ্ডলকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা। সেখানে অ্যন্টিভেনম না থাকায় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার আগেই পথে চায়না মণ্ডলের মৃত্যু হয়। গত ৯ জুলাই জেলার শ্রীনগর উপজেলার খাগ্রা গ্রামে সাপের কামড়ে মারা যায় ছয় বছরের ওসমান গনি। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, গনিকে শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। কারণ ওই হাসপাতালেও তখন অ্যান্টিভেনম ছিল না। পরে গনিকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘গত ১৫ জুন চায়না মণ্ডল নামের সাপে কাটা এক নারীকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে। তখন জেনারেল হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ না থাকায় তাঁকে আমরা ঢাকায় পাঠিয়ে দিই। হঠাৎ করে সাপে কামড়ানো রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে জেনারেল হাসপাতালসহ সব কয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনমসহ প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক আনা হয়েছে।’

জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় নিলাখিয়া ইউনিয়নের দিকপাড়ায় গত ১৮ জুন দুপুরে সাপের কামড়ে আবু সাঈদ (৮) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক অ্যান্টিভেনম না থাকায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে শিশুটির মৃত্যু হয়। জেলার মাদারগঞ্জের জোড়খালী ইউনিয়নের চরগোলাবাড়ীতে গত ৪ জুলাই বৃদ্ধা রাবেয়া বেগমকে সাপ কামড় দিলে তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। কবিরাজ ঝাড়ফুঁক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে ওই রাতেই রাবেয়ার অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।

ইসলামপুর উপজেলা হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নেই জানিয়ে ইসলামপুর উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসক এ এ এম আবু তাহের বলেন, ‘আমাদের এখানে সাপের কামড়ের রোগী এলে জামালপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। রোগীকে পর্যবেক্ষণে রেখে অ্যান্টিভেনম দিতে হয়। তা না হলে রোগীর সমস্যা হতে পারে। এ জন্য কার্ডিওলজির চিকিৎসক প্রয়োজন। এই পদে চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পদ্মার চরাঞ্চল, মহানন্দা নদীর তীরঘেঁষা এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও জেলার আমবাগানগুলোতে রাসেলস ভাইপারসহ (চন্দ্রবোড়া) বিভিন্ন বিষাক্ত সাপের উপদ্রব বেড়েছে। বেড়েছে সাপে কাটা রোগী। তাদের বেশির ভাগ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরও মারা যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর জন্য অ্যান্টিভেনমের সংকট রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *