সাত্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে আসিফকে যেভাবে নির্বাচনের মাঠ ছাড়তে হয়

‘নিখোঁজ’ অবস্থা থেকে ফেরার পর আশুগঞ্জের শরীয়তনগর এলাকায় নিজ বাসায় আবু আসিফ আহমেদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচন থেকে যখন ‘চাপের মুখে’ একে একে প্রায় সবাই সরে যাচ্ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট বিএনপির দলছুট নেতা আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার সামনে টিকে ছিলেন বিএনপির সাবেক নেতা আবু আসিফ আহমেদ। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার শেষ সময়ে এসে তিনিও হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান। অনেকটা ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই নির্বাচনে জিতে যান সাত্তার। আর নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে ভোটে হারা আসিফ জামানতও হারান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির রাজনীতিতে সাত্তার ভূঁইয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, তেমনি আশুগঞ্জের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সবার ধারণা ছিল, উপনির্বাচনের লড়াইয়ে এই দুজনের মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কিন্তু তা হয়নি।
আবু আসিফ বললেন, কী হয়েছে আ.লীগের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন
আসিফ যেভাবে সাত্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন
গত ৮ জানুয়ারি এই উপনির্বাচনের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছায়ের পর আটজনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ছিলেন আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা। তাঁদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মঈন উদ্দিন হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাত্তার ভূঁইয়ার সঙ্গে লড়ে হেরে গেলেও তাঁর কাছাকাছি ভোট পেয়েছিলেন। এবারও নির্বাচনের মাঠে তাঁর বেশ দাপট ছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামা অন্য দুই আওয়ামী লীগ নেতা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী ও স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম। কিন্তু দলীয় ‘চাপে’ তাঁরা তিনজনই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী সরে দাঁড়ানোর পর সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়ে ওঠেন জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত দুইবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। পরে তাঁকেও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে ‘বাধ্য’ করা হয়।
আওয়ামী লীগের তিনজন এবং জাতীয় পার্টির দুইবারের সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল নির্বাচন থেকে সরানোর পর সাত্তারসহ নির্বাচনের মাঠে ছিলেন চারজন। অপর তিনজন হলেন আবু আসিফ আহমেদ, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ আসিফই ছিলেন সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আবু আসিফ জোরেশোরেই প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
আবু আসিফ যেভাবে মাঠ ছাড়েন
আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারণা যখন তুঙ্গে, তখন গত ২৫ জানুয়ারি প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে (৮০) গভীর রাতে আশুগঞ্জ পূর্ব বাজার বিওসি ঘাট এলাকার বাসা থেকে তুলে নেয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরদিন তাঁকে একটি মামলায় কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ওই রাতেই এলাকা ছাড়া হন আবু আসিফের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী ও তাঁর শ্যালক শাফায়াত সুমন (৩৮)। এরপর ধীরে ধীরে আবু আসিফের নির্বাচনী মাঠ হাত ছাড়া হতে থাকে। তিনি হয়ে যান নিষ্ক্রিয়।
তখন আসিফের স্ত্রী মেহেরুননিছা মেহেরীন অভিযোগ করতেন, তাঁদের বাড়ির আশপাশে অচেনা লোকজন সারা দিন অবস্থান করে। বাইরের কাউকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। ভয়ে কর্মী-সমর্থকেরা এলাকা ছাড়ছেন। আবু আসিফের অভিযোগ ছিল তাঁকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেছিলেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনিই বিজয়ী হবেন।
২৭ জানুয়ারি ‘নিখোঁজ’ হন আবু আসিফ আহমেদ। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে তার নির্বাচনী মাঠ ভেস্তে যায়। নির্বাচনী মাঠে আলোচনার শীর্ষে আসে তাঁর নিখোঁজের বিষয়টি। তাঁর স্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, আবু আসিফ কোথায় আছেন, সেটি তিনি জানেন না। এরপর নির্বাচন থেকে তাঁর কর্মী-সমর্থকেরাও সরে যান।
চাপ অনুভব করাতে নির্বাচন থেকে সরে গেছি: আবু আসিফ
বিকেলে বাসায় ফেরেন আবু আসিফ আহমেদ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আশুগঞ্জের শরীয়তনগর এলাকায়
নির্বাচনের দিন আবু আসিফের লোকজনকে মাঠে দেখা যায়নি। সেদিন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিনিধি পুরো নির্বাচনী এলাকার ১৭টি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে একটিতেও আবু আসিফের কোনো এজেন্ট পাননি। আবু আসিফ ফিরেছেন নির্বাচনের পর দিন। ফিরে এসে নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তাঁর ‘নিখোঁজ’ হওয়া নিয়ে তেমন কিছুই বলেননি। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন থেকে সরে গেছি, ভোট দিইনি। নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য নাই।’
নির্বাচনে আবু আসিফ পেয়েছেন ৩ হাজার ২৬৯ ভোট। এই আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯। ভোট পড়েছে ৬০ হাজার ১২২টি। নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী, প্রদত্ত ভোটের এক–অষ্টমাংশের কম ভোট পেলে প্রার্থী জামানত হারাবেন। এ হিসাবে আবু আসিফ জামানত হারাচ্ছেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *