সীমান্ত বৈঠকের প্রস্তুতিমূলক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত ভারতকে কোনো ছাড় নয়

জানুয়ারি ৩০, ২০২৫ সাপ্তাহিক জনতার কণ্ঠ

নয়াদিল্লিতে আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রæয়ারি ৫৫তম বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন

ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ১৫ বছর হাসিনা রেজিম দিল্লির তাবেদারি করলেও ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। ঢাকা এখন দিল্লির পায়ের দিকে তাকিয়ে ‘ইয়েস স্যার’ করে না চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়েছে। ফলে দু’দেশের আসন্ন সীমান্ত সম্মেলনে বাংলাদেশের ‘টোন’ ভিন্ন হবে। আগামী ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়াদিল্লিতে ৫৫তম বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠিতব্য ওই বৈঠকে ভারতকে কোনো ছাড় দেবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার লক্ষ্যে গতকাল বুধবার প্রস্তুতিমূলক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় অংশ নেন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় এবং দফতর/সংস্থার প্রধানরা। এ সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা মনে করছি যে, আমরা বঞ্চিত হয়েছি সে বিষয়গুলোতে আমরা কোনো ছাড় দেব না।’ তিনি জানান, সীমান্ত হত্যা এই বৈঠকের মূল আলোচ্যবিষয় হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার পর হিন্দুত্ববাদী ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে। বাংলাদেশে অস্থিতিশীল সৃষ্টির চেষ্টায় নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ অবস্থায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে যে সব গোপন চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো প্রকাশের দাবি তোলেন। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে অতীতের নতজানু ক‚টনৈতিক সম্পর্ক পরিহার করে ‘চোখে চোখ রেখে’ কথা বলার দাবি জানান। এমনকি তারা ভারতের পণ্য বর্জনের দাবিতে জনমত গড়ে তোলেন। এ সময় দেশের আমজনতা ভারতের পণ্য বর্জন আন্দোলনে নামে এবং আমজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের সমর্থন জানান। এরই মধ্যে ভারত সীমান্তের বিভিন্ন স্পটে কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করলে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী ও আমজনতা সেটা রুখে দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে দু’দেশের সীমান্ত বৈঠকের আয়োজন করা হচ্ছে।

সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন সংক্রান্ত বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও ভারতীয় নাগরিকরা সীমান্তে নিরস্ত্র-নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর হামলা ও গুলি চালানোসহ সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। অনেক সময় বিএসএফ এবং ভারতীয় নাগরিকরা কৃষি কাজ করা অবস্থায় বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে যায়। এসব কর্মকাÐ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবং স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমুন্নত রেখেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে সবার সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) ফয়সল হাসান জানান, বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সংক্রান্ত দ্বি-পাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, দফতর এবং সংস্থার সমন্বয়ে এই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আসন্ন বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্ত সম্মেলনে বিজিবি’র প্রতিনিধি ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতর, ভ‚মি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর এবং যৌথ নদী কমিশনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন। সভায় সীমান্ত হত্যা, শ‚ন্য লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানবপাচার, নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন, নদী থেকে পানি উত্তোলন, পানি চুক্তি বাস্তবায়ন এবং নদী তীর সংরক্ষণমূলক কাজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সীমান্তের সব সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারণ এবং উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের মধ্যে মোট ৪টি চুক্তি রয়েছে। চুক্তিতে উভয় দেশের প্রয়োজনে শ‚ন্য লাইন থেকে ১৫০ গজের মধ্যে যেকোনও উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্নের ক্ষেত্রে একে-অপরের সম্মতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয়রা অনেক সময় মাদক তৈরি করে। সেখানে তারা ফেন্সিডিল তৈরি করে আমাদের দেশে ঢুকিয়ে দেয়। তারা ফেন্সিডিলগুলো ওষুধ হিসেবে বানাচ্ছে বললেও আসলে এটা মাদক হিসেবেই বানানো হয়। তিনি আরো বলেন, সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো কাজ করতে হলে দুই পক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এগুলো একপক্ষে করার নিয়ম নাই। যদিও তারা এভাবেই করতে চায়। উন্নয়নমূলকভাবে একটা মসজিদ বা মন্দির করতে হলে দুই দেশের সম্মতি প্রয়োজন হয়। আগামীতে কিছু করতে হলে যেন তারা সম্মতি নেয় এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হবে। বিএসএফ বা ভারতীয় নাগরিক/ভারতীয় দুষ্কৃতকারী কর্তৃক সীমান্ত হত্যা/সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো বা কাউকে আহত করা বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা হবে। সম্মেলনে বিএসএফ বা ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া বা আটক করা বন্ধ করতে আলোচনা করা হবে।

বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তিগুলো নিয়ে কাজ করতে। এটা ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে সমাধান করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যেগুলোতে আমরা মনে করছি যে, আমরা বঞ্চিত হয়েছি সে বিষয়গুলোতে আমরা কোনো ছাড় দেব না। তিনি আরো বলেন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সম্মেলনে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের নিয়ে আমরা বসবো। সেখানে আপনারা সুনির্দিষ্ট তথ্য পাবেন। বর্ডার কিলিং এই সম্মেলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। মোট কথা কোনো বিষয়ে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এক. বিএসএফ, ভারতীয় নাগরিক, ভারতীয় দুষ্কৃতকারীরা সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো ও আহত করা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া ও আটক বন্ধ করতে হবে। দুই. বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের সীমানা লংঘন ও অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ভারত থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন প্রকার অবৈধ মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক দ্রব্য চোরাচালান প্রতিরোধ ও বন্ধ করতে হবে। তিন. সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে ভারতের অনুমোদনহীন উন্নয়নমূলক অবকাঠামো নির্মাণকাজ এবং বিএসএফের বাধায় বন্ধ থাকা বাংলাদেশ পার্শ্বের উন্নয়নমূলক কাজ নিষ্পত্তি করতে হবে। চার. আগরতলা থেকে আখাউড়ার দিকে বর্জ্য পানি প্রবাহিত হয়। এমন চারটি খালে পানি শোধনাগার স্থাপন করতে হবে। পাঁচ. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী নদীগুলোর পানির সুষম বণ্টন, নদী হতে পানি উত্তোলন, পানি চুক্তি বাস্তবায়ন এবং রহিমপুর খালের মুখ পুনরায় উন্মুক্ত করতে হবে। ছয়. বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিক ও দুষ্কৃতকারীদের আন্তর্জাতিক সীমানা লংঘন করে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ রোধ করতে হবে। সাত. বিতর্কিত মুহুরির চর এলাকায় সীমানা নির্ধারণ, বিভিন্ন এলাকায় বর্ডার পিলারে স্থাপনের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। আট. বাংলাদেশের বর্তমান বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। নয়. সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের জন্য ‘কার্যকর সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করতে হবে। দশ. পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *