খুশি মনে অন্যের অধিকার দিয়ে দেওয়া সভ্য, ভদ্র ও আলোকিত মানুষের পরিচয়। এর বিপরীতে অসভ্য, বর্বর ও অশিক্ষিত মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের প্রাপ্য অধিকার প্রদান না করা।
ছলে, বলে, কৌশলে অন্যকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে ঠকানো মন্দ মানুষের কাজ।
আমরা জানি, পবিত্র কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে পৃথিবীর মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা জন্য, মানুষকে সভ্য ও ভদ্র বানানোর জন্য। তাই অধিকার আদায় কোরআনে কারিমের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
সূরা আন নিসা। পবিত্র কোরআনে কারিমের চতুর্থ সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ১৭৬টি। এ সূরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। আরবি নিসা শব্দের অর্থ নারী। যেহেতু এ সূরায় নারীদের বিভিন্ন অধিকারের আলোচনা বেশি করা হয়েছে তাই এ সূরার নাম আন নিসা রাখা হয়েছে।
এ সূরায় নারীদের বৈষয়িক নানা অধিকার- যথা বিয়ে, সম্পত্তি, দেনমোহর, উত্তরাধিকার সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব নীতি সমাজের গরীব ধনী সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
এ সূরায় বিঘোষিত হয়েছে, এতিম মেয়ে শিশুর সম্পদের অধিকারের বিষয়ে। এ ছাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে তার যে স্বাধীনতা ও অধিকার সেটও দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এ সূরায় সুস্পষ্ট ভাষায় নারীদের বিভিন্ন অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। মৃত আপনজনের সম্পদে নারী কতটুকু অংশ পাবে তা এ সূরায় সেটা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। স্বামীর সংসারে নারীর প্রাপ্য অধিকার কতটুকু ও কী কী সেটা নির্ধারণ করে দিয়ে নারীদের ঠকানোর পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এ সূরায়।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হলে, সম্পর্ক তিক্ত হলে কিভাবে তার সমাধান করতে হয়- তাও শিখানো হয়েছে সূরা নিসায়। শান্তি ও সুখের জন্য বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটানো যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে তবে তা কিভাবে সম্পাদন করতে হবে সেসব দিক-নির্দেনা রয়েছে এ সূরায়। বিয়ে বিচ্ছেদের সময় নারীর সম্মান ও অধিকার যেন কোনোভোবেই ক্ষুন্ন না হয় তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগের মানুষ নারীকে ঠকাতো। নারীর ওপর নানাবিধ জুলুম করত। নারীর ব্যক্তিত্ব ও সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য বিভিন্ন ফন্দি আঁটত। সূরা নিসায় আলোচিত ও বর্ণিত বিভিন্ন বিধানের মাধ্যমে এসবের দরোজা চিরতরে রুদ্ধ করা হয়েছে।
নারী নির্যাতনরোধে ও নারীদের অধিকার আদায়ের নিমিত্তে পৃথিবীতে উচ্চারিত প্রথম সনদের নাম সূরা নিসা। বিশ্ববাসীকে নারী অধিকারের ধারণা দিয়েছে এ সূরা। পৃথিবীতে নারী মুক্তি, নারী উন্নয়ন আর নারী অধিকারের পথচলা শুরু হয়েছে সূরা নিসার পথ ধরে। এ বিষয়ে সূরা নিসার অবদান পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে হলে, সূরা নিসা অধ্যয়ন করার আগে তদানীন্তন বিশ্বে নারীর মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে হবে।
সূরা নিসার আলোচনা শুরু হয়েছে তাকওয়ার আলোচনা দিয়ে। নারীর অধিকারসমূহ আলোচনার সময়ও বারংবার তাকওয়ার কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, তাকওয়া অর্থ আল্লাহভীতি। আমার জানি, আইন-আদালত, সংবিধান ও যাবতীয় বিধি-বিধান তখনই শতভাগ কার্যকর হয়- যখন মানুষ মন থেকে সে সব মানে। তাই আল্লাহতায়ালা নারীর অধিকার বিষয়ে পুরুষের মনের ভেতর স্থায়ী বিপ্লব ও চেতনা জাগ্রত করার জন্য বারবার তাকওয়ার কথা বলেছেন । আর মনে তখনই বিপ্লব আসবে, যথন মনে আল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাব দেওয়ার প্রসঙ্গ থাকবে।
এ সূরার প্রথম আয়াতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের মাঝে সুবৃহৎ ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন স্থাপন করার মূলমন্ত্র শিখানো হয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াতে এতিমের সম্পদ আত্মসাতের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে ও এতিমের অভিভাবককে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। সূরা নিসার তৃতীয় আয়াতে বহুবিবাহের অনুমতি ও শর্তসমূহ বিবৃত হয়েছে।
বহুবিবাহ পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাস। আর্থসামাজিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে বহুবিবাহের দরকার হয়। সময়ের অনেক সঙ্কটকালে অসহায় নারীর সম্মানজনক সহায়ের জন্য বহুবিবাহের কোনো বিকল্প থাকে না। তাই কোরআনে কারিমে বহুবিবাহকে অনুমতি দিয়েছে। আবার বহুবিবাহের দ্বারা সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন অনাচার ও নারীনির্যাতন বন্ধ করার জন্য বহুবিবাহের অনুমতিকে শর্তাধীন করে রেখেছে। বহুবিবাহের জন্য বেশি নয়, মাত্র একটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। আর এ শর্তের বাস্তবায়ন পরিবারে সুখ, শান্তি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট।
এ সূরার পাঁচ ও ছয় নম্বর আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, অপরের সম্পদ নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা অন্যদের আবশ্যকীয় দায়িত্ব। সম্পদের মালিককে কখন তার সম্পদ বুঝিয়ে দিতে হবে, বিশেষ করে এতিমের সম্পদ কখন তার হাতে ছেড়ে দিতে হবে সে দিক-নির্দেশনা এখানে দেওয়া হয়েছে। দশম আয়াতে এতিমের আত্মসাৎ পরকালে ভয়ঙ্কর পরিণতির কারণ হবে বলে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
এগারোতম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ মারা গেলে তার সন্তানরা বিশেষ করে মেয়ে সন্তানরা কতটুকু অংশ পাবে এবং তার মাতা-পিতা কতটুকু অংশ পাবে। বারোতম নম্বর আয়াতে আছে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কতটুকু অংশ পাবে আর স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কতটুকু অংশ পাবে। সেই সঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে, বৈপিত্রিয় ভাই-বোনের অংশও।
তওবার আলোচনা করা হয়েছে এ সূরার সতেরো ও আঠারোতম আয়াতে। এর পরের আয়াতে নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সদাচরণ বিষয়ে নানা আলোচনা স্থান পেয়েছে। কোন নারীকে বিয়ে করা যাবে, আর কোন নারীকে বিয়ে করা যাবে না- তা বলা হয়েছে বাইশ ও তেইশতম আয়াতে।
চব্বিশতম আয়াতে বিয়ের সময় দেনমোহর প্রদান করাকে ফরজ সাব্যস্ত করা হয়েছে। ঊত্রিশতম আয়াতে মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতে ও মানুষকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কারো সন্তুষ্টি ব্যতীত তার সম্পদ অপরের জন্য কখনো বৈধ হবে না।
পরিবারের প্রধান কে হবে, কে হবে পরিবারের দায়িত্বশীল এবং কেন? এ বিষয়ে যুক্তিভিত্তিক সারসংক্ষেপ আলোচনা স্থান পেয়েছে সূরার চৌত্রিশতম আয়াতে। সেই সঙ্গে ভালো নারীর গুণাবলীও এখানে বলে দেওয়া হয়েছে।
আমানত রক্ষা ও বিচারকাজে নিরপেক্ষ থাকার কঠোর আদেশ দেওয়া হয়েছে আটান্ন নম্বর আয়াতে। এরপর আলোচনা করা হয়েছে মুনাফিকদের প্রসঙ্গে। বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের ফায়সালাকে মেনে নিতে পারে না, যারা ইসলামকে এড়িয়ে মানব রচিত আইনের দ্বারা জীবনের সমাধান করতে চায়- তারাই মুনাফিক।
সূরা নিসায় আরও আলোচনা করা হয়েছে, জিহাদের নির্দেশ, ফজিলত ও উদ্দেশ্যসমূহ। সেই সঙ্গে মানুষকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিম অধ্যয়ন করার ও কোরআন নিয়ে গকেষণা করার।
কোনো বিষয়ে সুপারিশ করার প্রক্রিয়া ও অন্যকে অভিবাদন জানানোর নিয়ম-কানুন শেখানো হয়েছে সূরার পঁচাশি থেকে সাতাশি নম্বর আয়াতে।
সূরা নিসায় আরও আলোচিত হয়েছে, মুনাফিকদের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও পরিণতি নিয়ে সম্পর্কে। সেখা বলা হয়েছে, মুনাফিকরা মর্যাদা ও ক্ষমতার লোভে মুমিনদের চেয়ে কাফেরদের প্রতি বেশি আন্তরিক ও দুর্বল থাকে। কষ্টের সময় তারা মুমিনদের সাথী হয় না। কিন্তু ভোগ ও ভাগের সময় তারাও দাবিদার সাজে।
ধর্ম বিষয়ে ইহুদিদের বিভিন্ন দাবি খন্ডন করে ইহুদিদের দুটি চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নিসায়। বলা হয়েছে, সুদ খাওয়া ও অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভোগ করা তাদের বৈশিষ্ট্য।