ছায়েম তৌহিদ : দিন শুরু হয় মাটির নীরবতার শব্দে। বগুড়ার ধুনটের বেড়েরবাড়ি গ্রামের মাটিতে, যেখানে সূর্য কেবল আলো নয়, অনুশীলনের আগুন ফেলে। সেই মাটির কোলে জন্ম নেয় এক তরুণ—রেজওয়ানুল ইসলাম—যিনি প্রাণে ধারণ করেন এক বিশাল স্বপ্ন, কিন্তু পুঁজি ছিল অল্প: মাত্র ১৬ হাজার টাকা—মাটির ব্যাংকে সংরক্ষিত কয়েন, বন্ধু ও আত্মীয়ের আর্ত সহায়তা—সেইটা তার সূত্রধর, সেইটা তার প্রথম বোঝা।
তাকে যারা জানে না, তারা হয়তো ভাবে, এটা ছোট লিখিনি; অথচ ১৬ হাজার—হতে পারে সংখ্যা, কিন্তু রেজওয়ানের জীবনে তা ছিল একটি বর্ষণ—শুরু, সাহস, আত্মবিশ্বাস—যেটা তাকে পুকুরের তীরে দাঁড় করায়। ২০১০ সালে সেই ছোট্ট পুকুরেই সে শুরু করে মাছ চাষ; ইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির ছোঁয়ায় প্রতিটি তরঙ্গ যেন বলত: “কষ্ট নয়, আশাই স্বপ্ন তৈরি করে।” সে যাত্রা শুরুর—প্রথম চাষে সফল না হলেও, সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ, সে হতাহতের সুযোগ এড়িয়ে ফিরে দাঁড়াল নিজের সৃজনশীলতা ও দৃঢ়তা নিয়ে।
হ্যাঁ, উপহাস ও সমালোচনাও আসলো—বিশ্বাসহীন চোখ, আঁচড়ে দেওয়া শব্দ। তথাপি সে ভেঙে পড়ল না। বরং সেই আঘাতেই ধাপে ধাপে ফিরে পেল দৃঢ়তা, বোধ হলো, পরাজয় নয়—এটাই তো মোটিভেশন।
এক বন্ধুর পরামর্শে সে কাঁধে তুলে নেয় স্বপ্ন: ‘বগুড়া যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে আধুনিক মৎস্যচাষের প্রশিক্ষণ নাও।’ এক মাসের প্রশিক্ষণে সে শিখলো মাছ চাষের প্রযুক্তি, যত্ন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাতের কলাকৌশল—এই স্পর্শেই মাটির আঁচলে উঠে এলো নতুন কীট সুর। প্রশিক্ষণের পর সেই পুরনো পুকুর ফের জীবন্ত হল; ভাঙা আশা পাটিয়ে নতুন জীবন দিলো সে—আর ফিরে তাকাতে হয়নি কখনো। ধীরে ধীরে এক নয়, নয়টি পুকুরে মাছ চাষ করলো সে; চাষ নয়, যেন এক শিল্প, এক গল্প যে প্রতিটি নুড়িতে ফুটে উঠে আধুনিকতার স্পন্দন—জীবনের স্পন্দন।
তখন থেকেই জন্ম হলো তার জীবনের মহাস্বপ্ন ‘গ্রিন ওয়ান’ যা হয়ে উঠলো তার চরিত্র, তার নীরব কবিতা, তার কাজের ছন্দ, তার মানুষের হাসির ব্যানার। এটি শুধু নাম নয়, এক চেতনার প্রতীক: ‘গ্রিন ফিশারিজ’, ‘গ্রিন অ্যাগ্রো ফার্ম’ ‘গ্রিন অর্গানিক ফার্টিলাইজার’, ‘গ্রিন অর্গানিক ল্যাবরেটরি’, ‘গ্রিন ওয়ান সিড’, ‘গ্রিন নার্সারি’, ‘গ্রিন গার্ডেনিং সার্ভিস’, ‘গ্রিন মাশরুম’, ‘গ্রিন অ্যানিমেল হাসবেন্ড্রি’ এবং ‘গ্রিন যুব ফাউন্ডেশন’—মোট সাতটি ইউনিটে ছড়িয়ে দশটি কৃষিকাজকে নিয়ে এক বিশাল সুর নির্মিত হলো তার মাটিতে ও মানুষের হৃদয়ে।
এই উদ্যোগ শুধুই কৃষিকাজ নয়—এটি মানবতার গান। ৫০ জন নারী-পুরুষ—বিধবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষসহ—আজ কর্মসংস্থানে যুক্ত; শুধু মজুরি নয়, তারা পেয়েছে আত্মসম্মান, কাজের মর্যাদা, আশা এবং জীবনের নতুন সূচনা। এর সঙ্গে—মাসিক গড় আয় ১০‑১৫ লাখ টাকা হলেও—বিশাল অংশ আস্থা, উন্নয়ন এবং সমাজসেবা ভেবে ব্যয় হয়।
তবে জীবনের কবিতা তখনই সত্যি হয়, যখন স্বীকৃতি আসে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব দিবসে, তার “আধুনিক কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ” প্রকল্পে তিনি পান জাতীয় যুব পুরস্কার। এই পালক শুধু তার নয়—গ্রামের, স্বপ্নের, মানুষের—যিনি বিশ্বাস করেছিলেন। পুরস্কার হাতে নিয়ে সে বললেন, “এই স্বীকৃতি আমার একার নয়—এই বিশ্বাসের, এই প্রতিশ্রুতির, এই গ্রামের মানুষের, যার প্রতিটি শব্দ ছিল আমার কাজের অনুপ্রেরণা।”
তার বিশ্বাস ছিল স্পষ্ট: “কৃষক হাসলে—দেশ হাসে; দেশে স্মৃতি গড়ে—সমৃদ্ধি ফুটে”—এই আশায় সে কাজ করে যাচ্ছে এবং তার চোখের আলো বলছিল—স্বপ্ন তো সন্ধানে, পরবর্তী পাঁচ বছরে ৫০০ জন কর্মসংস্থান, প্রতিটি জেলায় ‘গ্রিন ওয়ান’ শাখা, ৩০ হাজার উদ্যোক্তা—এটাই তার উদ্দেশ্য, এটাই তার চাওয়া।
রেজওয়ানুলের জীবন, সেই স্বপ্ন আর শক্তির সন্ধানে—প্রতিটি বাক্য যেন মাটির ভেতর চেপে থাকা বীজ, যার থেকে গজায় প্রত্যাশার নিঃশব্দ ফুল। তাঁর সংগ্রাম—একটি পুঁজি নয়, একটি কবিতা; তাঁর উদ্ভাবন—টেকসই, আধুনিক, মানবমুখর; তাঁর মানবিকতা—পরিচয় দেয় এক সমাজ গড়ে দেওয়ার বিন্যাস; তাঁর ভবিষ্যৎ—পাঁচ বছরের স্বপ্ন নয়, এক প্রত্যাশা, যে প্রত্যেক কর্মজীবীকে হাত ধরিয়ে চালাবে।
অধৈর্য মাটিকে আলোয় তোলার সে কবি, যার গদ্য—শব্দের ছন্দে, আশা উঁকি দেয় সক্রিয় জীবনে, যার চরিত্র—নীরবে নির্মাণ করে এক স্বপ্নপুরী, যাঁর কীর্তি—গ্রামের, দেশের, স্বপ্নের প্রেরণা।
জাতীয় পুরস্কার—গ্রামের হাসি, দেশের বিশ্বাস।
ভবিষ্যৎ দিগন্তে; ৫০০ কর্মসংস্থান, ৩০,০০০ উদ্যোক্তা—প্রতিটি লোকের জীবনে এক নূতন কৃষিকবিতা।