ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ইবাদত হজ্ব। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে কোটি মুসলমানের হৃদয়ে জাগ্রত হয় একটি স্বপ্ন, পবিত্র কাবা শরিফের সামনে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর দরবারে সিজদা দেওয়ার। মক্কা ও মদীনার পথে সফর করা শুধু একটি ভ্রমণ নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমর্পণের এক পরম যাত্রা।
আফসোস, এই পবিত্র ইবাদতের নামে কেউ কেউ প্রতারণার মতো জঘন্য পাপ করতে দ্বিধা করে না। ২০২৩ সালে কানাডার টরন্টোতে বসবাসরত ৩২ জন প্রবীণ বাংলাদেশির জন্য সেই স্বপ্ন পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে। এই ঘটনাটি যেন ধর্মের পবিত্রতা আর বিশ্বাসের প্রতি এক নির্মম উপহাস।
৪০ বছর বয়সী শাহরিয়ার আহমেদ—মসৃণ চুল, ঝকঝকে হাসি, মুখে সর্বদা ‘ইনশাআল্লাহ’ আর ‘জাজাকাল্লাহ’ উচ্চারণকারী এই মানুষটি নিজেকে পরিচয় দিতেন একজন অভিজ্ঞ হজ্ব ট্রাভেল কনসালট্যান্ট হিসেবে। “Dreamland Hajj & Umrah Services” এবং “Shahriar Travels” নামের দুটি ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সির ব্যানারে তিনি টরন্টোর বাংলাদেশি হজ্বযাত্রীদের আকৃষ্ট করেন। অথচ এই এজেন্সিগুলোর কোনো TICO (Travel Industry Council of Ontario) রেজিস্ট্রেশন ছিল না। প্রবীণ ও ধর্মভীরু কমিউনিটির প্রবীণ মানুষদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে তিনি মোট $৪২০,০০০ কানাডিয়ান ডলার আত্মসাৎ করেন। যা ছিল হজ্বে পাঠানোর নাম করে সাজানো এক নিষ্ঠুর প্রতারণার ফাঁদ।
২০২২ সালের বসন্ত। টরন্টোর এক মসজিদে একটি পোস্টার দেখে আকৃষ্ট হন ৬৩ বছর বয়সী আশরাফ আলী। দীর্ঘদিনের এক প্রার্থনার ডাক যেন তাকে আকর্ষণ করে। পরিচিত হন শাহরিয়ার আহমেদের সঙ্গে যিনি নিজেকে “সৌদি সরকারের অনুমোদিত প্রতিনিধি” বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, “একটি বিশেষ অফার চলছে মাত্র $৮,০০০ ডলারে (প্যাকেজের প্রকৃত মূল্য $১২,০০০ ডলার); পূর্ণাঙ্গ হজ্ব প্যাকেজ- এয়ার টিকেট, ভিসা, হোটেল, খাওয়া দাওয়া সব ইনক্লুডেড।”
মোহে পড়ে যান আশরাফ আলী—নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য তুলে দেন জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নগদ $২৪,০০০ ডলার। শাহরিয়ার তার হাতে ধরিয়ে দেন একটি রিসিপ্ট। কাগজে সৌদি এয়ারলাইন্সের লোগো—নিখুঁত মনে হলেও তা ছিল জাল।
শাহরিয়ারের অপারেশনাল পদ্ধতি ছিল চমকপ্রদ। প্রথমতঃ কমিউনিটিতে ট্রাস্ট বিল্ডিং করার জন্য তিনি স্থানীয় মসজিদে দান করতেন। দ্বিতীয়তঃ, প্রবীণদের বাড়িতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন অজুহাতে সৌদি খেজুর, জমজমের পানি, আতর উপহার দিয়ে আত্মীয়তা গড়তেন। তার টার্গেট ছিল সিনিয়র সিটিজেন।
শুক্র, শনি ও রোববার মাগরিবের সময় তিনি বিভিন্ন মসজিদে যেতেন, মুরব্বিদের সাথে কথা বলতেন, মোবাইল ফোনে একটি ভুয়া ওয়েবসাইট (www.dreamlandhajj.ca) খুলে দেখাতেন, যেখানে “সৌদি হজ্ব মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন” লিখা ছিলো। এভাবেই তিনি মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করতেন। প্রতিবারই দেখা হলে বলতেন, ‘দেরি করছেন কেন? জমা দিন তাড়াতাড়ি, নাহলে স্লট মিস করবেন।’ ৩২ জন বাংলাদেশি অভিবাসী, যাঁদের অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব, বিশ্বাস করে দিলেন তাদের জীবনের সঞ্চয়। কেউ ই-ট্রান্সফার করলেন, কেউ আবার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলেন, আবার কেউ ক্যাশ হস্তান্তর করলেন নিজের হাতে।
২০২৩ সালের মার্চ। শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে দেখা যায় তার ফোন বন্ধ। এক ভুক্তভোগী সৌদি দূতাবাসে ফোন করে জানতে চাইলেন তার ভিসা প্রসেসিংয়ের অবস্থা। উত্তর এলো, ‘এই নামে কোনো আবেদনই নেই।’ দায়ের করা হলো অভিযোগ। তদন্তে নেমে পড়লো পিল রিজিওনাল পুলিশের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। এরপর একে একে ধরা পড়তে থাকে প্রতারণার জাল। এক পর্যায়ে শাহরিয়ারের ৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলো।
তদন্তে উঠে আসে Shahriar Travels নামে কোনো অনুমোদন নেই, বুকিং কনফার্মেশন যেসব ইমেইল পাঠানো হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভুয়া, এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে যাতে ট্রেস করা কঠিন হয়।
শাহরিয়ার আহমেদ ২০১৫ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় আসেন, কিন্তু সেনেকা কলেজে তার কোনো ক্লাসে হাজিরার রেকর্ড নেই। পরে রিফিউজি ক্লেইম করেন কিন্তু তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। অবশেষে ২০১৮ সালে ফিলিপিনো এক মেয়েকে বিয়ে করে তার স্পন্সরশিপে স্থায়ী বাসিন্দা হন।
২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে একটি ক্রেডিট কার্ড স্ক্যামের অভিযোগে শাস্তি হয়েছিল—যদিও মাত্র কন্ডিশনাল ডিসচার্জ।
হজ্ব প্রতারণার সময় তার জীবনযাপন ছিল বিলাসবহুল। তদন্তে জানা যায়, Yorkville এলাকার এক ডায়মন্ড জুয়েলারিতে $৩৮,০০০ ডলার খরচ করেছেন, Escort সার্ভিসে গেছে $২৫,০০০ ডলার। ভুয়া নাম ব্যবহার করে একাধিক জায়গায় অর্থ ব্যয় করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে হোটেল রিজার্ভেশন, থাই স্পা এবং ব্র্যান্ডেড পোশাক কেনা ইত্যাদি।
Peel Regional Police-এর ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ট্র্যাক করে শাহরিয়ারের Google ড্রাইভে ১৭টি ফেইক ভিসা টেমপ্লেট খুঁজে পায়।তার Binance অ্যাকাউন্ট থেকে $১৮৫,০০০ ডলার Bitcoin-এ কনভার্টের প্রমাণ মেলে।
২০ জানুয়ারি ২০২৩ সালে শাহরিয়ারকে কৌশলে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মামলাটি খারিজ করার শর্তে তিনি একজন আন্ডারকভার অফিসারকে $১০,০০০ ডলার উৎকোচ দেওয়ার মুহূর্তে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তার ব্যাগে পাওয়া যায় ফিলিপাইন্সের ওয়ান-ওয়ে টিকিট।
২০২৩ সালের মার্চে Ontario Court of Justice-তে শাহরিয়ারের বিচার শুরু হয়। ভুক্তভোগী ফাতেমা আদালতে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার স্বামী মারা গেছেন কাবা দেখতে না পেয়ে… এই লোকটা আমাদের ঈমানের সঙ্গে খেলেছে!”
শাহরিয়ার আদালতে দোষ স্বীকার করেন এবং তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশে তার বাড়ি ও গাড়ি বিক্রি করে ভুক্তভোগীদের মধ্যে $৩৮০,০০০ ডলার ফেরত দেওয়া সম্ভব হলেও, অবশিষ্ট $৪০,০০০ ডলার পাওয়া যায়নি। তদন্তে জানা যায়, বেশ কিছু অর্থ তিনি রূপান্তর করেছিলেন ‘মনেরো’ (Monero) নামক একটি বিশেষ ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সিতে—যার লেনদেনপ্রবাহ এমনভাবে এনক্রিপ্টেড থাকে যে তা অনুসরণ বা ট্রেস করা প্রায় অসম্ভব।
এ মামলায় আদালত TD Bank-কে $৭৫,০০০ ডলার জরিমানা করে। তদন্তে TD Bank এর ৩টি গুরুতর ভুল ধরা পড়ে।
১) SAR (Suspicious Activity Report) জমা দেওয়ায় ব্যর্থতা। শাহরিয়ার আহমেদের অ্যাকাউন্টে ১৪ মাসে $৩২০,০০০ ডলার জমা হয়েছিল (প্রতি মাসে $২৩,০০০ ডলার)।
২) শাহরিয়ার ৪৭ বার ক্যাশ উত্তোলন করেছিলেন, প্রতিবার $৯,৯০০ ডলার (রিপোর্টিং লিমিট $১০,০০০ ডলারের ঠিক নিচে, যা “Structuring” বা টাকা পাচারের কৌশল হিসেবে পরিচিত)।
৩) ক্লায়েন্ট ভেরিফিকেশন ব্যর্থতা। শাহরিয়ার তার অ্যাকাউন্টে “Shahriar Travels” নাম ব্যবহার করলেও এটি ছিল ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট (কোনো ব্যবসায়িক রেজিস্ট্রেশন নেই)।
TD Bank এই অসঙ্গতি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করেছিল বলে আদালত প্রমাণ পেয়েছে।
এ মামলার পর, ২০২৪ সালে প্রাদেশিক পর্যায়ে নতুন আইন আসে। এখন থেকে ট্রাভেল এজেন্টদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ইন্সুরেন্স ও ক্ষতিপূরণ ফান্ড।
২০২৪ সালের মে মাসে, ক্যালগারিতেও একই পদ্ধতিতে ১৫ জনের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে যেটির তদন্ত চলমান।
হজ্বের মতো পবিত্র কাজের সুযোগ নিয়ে যারা প্রতারণা করে, তারা শুধু অর্থ নয়, মানুষের বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুভূতি আর মানসিক স্থিতিকে ধ্বংস করে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে—’সতর্কতা’ই হলো একমাত্র পথ। কারণ প্রতারকরা সব সময়ই থাকবে, কিন্তু আমাদের সজাগ দৃষ্টিই হতে পারে প্রতিরোধের প্রথম ধাপ।
দ্রষ্টব্য (Footnote):
আইনি সীমাবদ্ধতা ও নৈতিক কারণে এ প্রতিবেদনের সকল নাম ও সংযুক্ত ছবি কল্পিত।
সূত্র:
- CBC (April 2023): Toronto Travel Agent Scammed Bangladeshi Community
- Toronto Star: Peel Police Freeze Assets in Hajj Fraud Case
- Court Documents (Ontario Justice): R. v. Ahmed [2023] ONCJ 291