হাজারো নদনদী ও উর্বর পলল ভূমি থাকার পরও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন খরচ বেশি উৎপাদন খরচে না জেহাল কৃষক

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫ সাপ্তাহিক জনতার কণ্ঠ

উৎপাদন খরচে নাজেহাল কৃষক

হাজারো নদনদী ও উর্বর পলল ভূমি থাকার পরও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন খরচ বেশি। ১১ বছরের ব্যবধানে দেশে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সরকারি হিসাবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৭ টাকা ২৬ পয়সা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকায়। চলতি বছরে উৎপাদন ব্যয় আরও ৮-১০ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এর প্রভাব পড়ছে চালের বাজারেও। উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হলেও এই সময়ে চালের দাম বেড়েছে তিন গুণের বেশি। বাড়তি সেই টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্ব¡ভোগীর পকেটে। ফলে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কৃষক।

১১ বছরে বেড়ে দ্বিগুণ ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক বাড়ছে চালের দাম

শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজ করেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মাহমুদ কামাল। তিনি বলেন, গতবার ৫০০ টাকায় শ্রমিক পেয়েছি, এবার ৭০০ টাকা দিতে হচ্ছে। গতবার এক কানি জমিতে সেচ দিতে ২ হাজার টাকা দিয়েছি। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবার খরচ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে। পাঁচ বছর আগে যে জমি আবাদ করতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হতো, এখন লাগে ৭০-৮০ হাজার। অথচ বিক্রিতে লাভ বাড়েনি। এখন আবাদ করা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদন ব্যয় ৩৩-৪৪ টাকা। সেখানে মিয়ানমারে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন ব্যয় ১১-১৭ টাকা, ভিয়েতনামে ১৭-২৮ টাকা ও ভারতে ২২-৩৮ টাকা। মিয়ানমারে সর্বনিম্ন উৎপাদন খরচের পেছনে কম শ্রমমজুরি, সেচে সর্বোচ্চ প্রাকৃতিক পানির ব্যবহার, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব সার ও কম দামের রাসায়নিক সারের ব্যবহার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের মোট চালের প্রায় ৫৬ ভাগ আসে বোরো মৌসুমে। বোরো আবাদে খরচ বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ, রাসায়নিক সারের দাম ও ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের বাড়তি মজুরি। আর শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে।  বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী, এক কেজি ধান উৎপাদনে ১৫০০ থেকে ১৭০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যার অধিকাংশ পূরণ করা হয় ভূগর্ভের পানি দিয়ে। সেচের পেছনেই খরচ হচ্ছে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ভূগর্ভের পানির ব্যবহার বাড়ায় প্রতি বছর গড়ে ৩-৫ ফুট নিচে নামছে পানির স্তর। গত ৫০ বছরে ঢাকাতেই পানির স্তর ২৩০ ফুট নিচে নেমেছে। এতে বছর বছর পাম্পের পাইপ আরও নিচে পাঠাতে হচ্ছে, বেশি হর্সপাওয়ারের মোটর বসাতে হচ্ছে। ফলে খরচ বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং ফলিত ভূতত্ত্ব গবেষণা সংস্থার তথ্যানুযায়ী, পানির স্তর ১ ফুট নিচে নামলে প্রতি একর জমিতে সেচ খরচ প্রায় ২-৩ শতাংশ বাড়ে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রমিজউদ্দিন বলেন, এক জমিতে বছরে ৩-৪ বার ফসল ফলাতে গিয়ে প্রচুর রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে, জমির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে প্রতিদিন বাসাবাড়িতে তৈরি লাখ লাখ টন জৈব বর্জ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে জৈব সার তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সেচের পানির বড় অংশ অপচয় হচ্ছে। এটা কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে নদনদী, খালবিল খনন করে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাতে সেচ খরচও কমবে, নদনদীর পানিতে পুষ্টি উপাদান থাকায় সার কম লাগবে। সেচনির্ভর বোরো আবাদ কমিয়ে বিকল্প ফসলের কথাও ভাবা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *