হিট স্ট্রোক কী? তীব্র দাবদাহে হিট স্ট্রোক এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ
ডা. সুমন নাজমুল হোসেন
গত দু’দিন ঢাকার তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৪০.৪ এবং ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার এই উত্তপ্ত আবহাওয়া আগে কখনো দেখিনি। সেই ৮০ এর দশকের মাঝামাঝি একবার ৪০ এর কাছাকাছি তাপমাত্রা উঠেছিল। ঢাকাতে ৪০ ডিগ্রি পেরুনো তাপমাত্রার ইতিহাস ১৯৬৫ সালের।
এই তাপমাত্রায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে বা কাজ করলে হিট এক্সহশন বা হিট স্ট্রোক হয়ে যাবার প্রবল ঝুঁকি আছে। হিট স্ট্রোক একটা মারাত্মক সমস্যা। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে এতে মৃত্যুর আশঙ্কা খুব বেশি।
Warm blooded animal এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষের শরীরের তাপমাত্রা বাইরের উত্তাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। পরিবেশের তাপমাত্রা যাই থাকুক, মানবদেহের তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রির মধ্যে বজায় থাকে। তবে এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার একটা সীমা আছে। গরমের মাত্রা খুব বেশি হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে শরীর আর পেরে ওঠে না এবং শরীরের তাপমাত্রা তখন বেড়ে যায়!
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য মস্তিষ্কে একটা বিশেষ অংশ কাজ করে। এর কার্যকারিতার মাধ্যমেই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে।
তাপমাত্রা বাড়ানো বা কমানোর জন্য শরীরের নানা কৌশল আছে। এর মধ্যে প্রধান হল ঘাম তৈরী করা এবং শরীর থেকে জলীয় বাষ্প নির্গত করে দেয়া। এই ঘাম ত্বক থেকে তাপ শুষে নিয়ে বাষ্পে পরিণত হয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনে। এছাড়াও ত্বকে রক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও শরীর তাপ ধরে রাখতে বা ছেড়ে দিতে পারে।
এবারের গরমের আরো দুটো অতিরিক্ত ফ্যাক্টর কাজ করছে। এবারে আর্দ্রতা তুলনামূলক কম। ফলে ঘাম কম হয়ে শরীর থেকে পানি সরাসরি বাষ্পীভূত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অগোচরে শরীর থেকে অনেক পানি বাষ্পীভূত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে যেটাকে চিকিৎসা পরিভাষায় insensible water loss বলা হয়। এ কারণে অনেকের চোখ, ঠোঁট এবং ত্বক শুষ্ক হচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে রোজা। রোজার কারণে দিনের বেলায় পানি বা খাদ্য গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে অন্য সময়ে অল্প ডিহাইড্রেশন পানিশূন্যতা হলেই পানীয় গ্রহণ করে তা আমরা সংশোধন করে ফেলি, এখন সেটি হচ্ছে না।
হিট এক্সহশন এর লক্ষণের মধ্যে আছে অতিরিক্ত দুর্বলতা, খুব বেশি ঘাম হওয়া, মাথা ব্যথা, ঘুরানো বা ঝিমঝিম করা, বমি ভাব, দৃষ্টি বিভ্রম এবং মারাত্মক পর্যায়ে আবোল তাবোল কথাবার্তা বলা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া! এসব লক্ষণের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে করণীয়?
১) জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দিনের বেলা বাইরে না যাওয়া। সম্ভব হলে এসিরুমে বা ফ্যানের নীচে থাকা। একান্তই বাইরে যেতে হলে রোদ এড়িয়ে ছায়ায় থাকা বা ছাতা ব্যবহার করা। এ সময়ে যে কোনো অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়াতে চেষ্টা করুন।
২) ঠান্ডা পানি দিয়ে দিনে এক বা সম্ভব হলে একাধিক বার গোসল করা। মাঝে মাঝে চোখ, মুখে পানি দেয়া।
৩) যারা রোজা রাখছেন, তারা ইফতার থেকে সেহেরির সময় পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি এবং তরল খাদ্য/ পানীয় গ্রহণ করুন। একবারে বেশি নয়, বরং এক ঘন্টা পরপর এক বা দুই গ্লাস পানি বা তরল খাদ্য গ্রহণ করুন।
৪) হালকা এবং পানিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করুন। শসা, তরমুজ, লাউ, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, দই, বরফ, আইসক্রিম ইত্যাদি গ্রহণ করা ভালো। গুরুপাক এবং পানির চাহিদা বাড়ায় এমন খাদ্য (পোলাও, খিচুড়ি, পরোটা, হালিম) বর্জন করুন।
৫) চোখ, ঠোঁট এবং ত্বকের বিশেষ যত্ন নিন। বিশেষত যাদের ডায়াবেটিস এবং চোখ ও চর্মরোগ আছে, তারা বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন।
৬) নিয়মিত যে সব ঔষধ খেতে হয়, সেগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করুন। যারা নিয়মিত হাঁটেন বা ব্যায়াম করে থাকেন, তারা দিনের তীব্র গরমের সময়গুলো বাদ দিয়ে ভোরে বা সন্ধ্যায় এসব করার চেষ্টা করুন।
৭) কারো হিট এক্সহশন বা হিট স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা গেলে তাকে অতিদ্রুত ছায়াতে বা সম্ভব হলে ঠান্ডা ঘরে নিয়ে আসুন। শীতল পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে বা গোসল করিয়ে দিন। ঠান্ডা পানি, বরফ, খাবার স্যালাইন বা তরল খেতে দিন। প্রয়োজনে মাথায়, বগলে, উরু এবং পেটের ওপরে বরফ দিয়ে সাবধানতার সাথে শরীর ঠান্ডা করতে পারেন। সেই সাথে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
রমজান, বৈশাখ এবং তীব্র দাবদাহের এই দুর্দান্ত কম্বিনেশনে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। আমরা সবাই এ বিষয়ে সতর্ক হই এবং নিজের ও পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন থাকি।
[লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারী বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।]