জনতার কণ্ঠ স্টাফ রিপোর্টার: জেলা পরিষদ যেন ‘বয়স্ক’ নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র জেলা পরিষদের প্রশাসকদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সময়ে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি।
মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. মহিউদ্দিনের বয়স এখন ৮১ বছর। ২০১১ সাল থেকে তিনি জেলা পরিষদের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি তিনি। গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিতেই তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে জেলা পরিষদের দায়িত্ব দিয়ে ‘সম্মানিত’ করেছে। তবে বয়সের কারণে প্রায়ই অসুস্থ থাকেন তিনি। ফলে জেলা পরিষদের দায়িত্ব তিনি কতটা পালন করতে পারেন, তা নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন আছে।
দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসকদের (সাবেক চেয়ারম্যান) বেশির ভাগই বয়সের দিক থেকে প্রবীণ। তাঁদের গড় বয়স ৬৮ বছর। এর মধ্যে ৮০ বছরের বেশি বয়সী রয়েছেন ৫ জন। সত্তরোর্ধ্ব প্রশাসক রয়েছেন ২৫ জন। অর্থাৎ প্রশাসকদের অর্ধেকের বেশি সত্তরোর্ধ্ব। জেলা পরিষদের প্রশাসকদের প্রায় সবাই বিভিন্ন সময়ে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এ জন্য স্থানীয়ভাবে তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘বঞ্চিত’ নেতা হিসেবে পরিচিত। তাই অতীতে দলের জন্য রাখা অবদান ‘মূল্যায়ন’ করে জেলা পরিষদে তাঁদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মতো জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে বেশ কিছু মানদণ্ড থাকে। দলের জন্য কতটা নিবেদিত ও ত্যাগী—এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়। যাঁরা দলের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, দল তাঁদের মূল্যায়ন করে। তবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক শারীরিক সক্ষমতার বিষয় থাকে। আগামী জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তর জেলা পরিষদকে বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ ১২ ধরনের বাধ্যতামূলক কাজ করবে। এ ছাড়া সাতটি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দও কম নয়। কিন্তু জেলা পরিষদগুলোর দৃশ্যমান কাজ নেই। বয়স্ক চেয়ারম্যানদের পক্ষে কাজের চাপ সামলানো কঠিন। কেউ কেউ নিয়মিত কার্যালয়ে আসেন না, একা চলাফেরাও করতে পারেন না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মাসিক সম্মানী ৫৪ হাজার টাকা ও আপ্যায়ন ভাতা ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধাও পান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা। একই সুবিধা এখন সরকার মনোনীত প্রশাসকেরা পাচ্ছেন।
স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরের মধ্যে অন্যতম জেলা পরিষদ। ২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদে বাকি ৬১টি জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথমবার প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। তখনো আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের প্রশাসক পদে বসানো হয়েছিল। দলের বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতারাই সরকার মনোনীত প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান।
দীর্ঘদিন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করার পর স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ২০০০-এর অধীনে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবার জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন হলেও জেলা পরিষদ আইনে প্রত্যক্ষ ভোটের বিধান নেই। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য নির্বাচন করেন সংশ্লিষ্ট এলাকার সিটি করপোরেশন (থাকলে), উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।
জেলা পরিষদের মেয়াদ পাঁচ বছর। একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের পাঁচজন নারী সদস্য নিয়ে এত দিন জেলা পরিষদ গঠিত হতো। তবে এই বিধান সংশোধন করা হয়েছে গত ৬ এপ্রিল। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, জেলা পরিষদের সদস্যের সংখ্যা নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট জেলার অধীন উপজেলার সংখ্যার ভিত্তিতে। অর্থাৎ কোনো জেলার অধীন উপজেলা ১০টি হলে জেলা পরিষদের সদস্য হবেন ১০ জন। এর সঙ্গে সংরক্ষিত নারী সদস্য যোগ হবে। এই হিসাবটি হবে পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সদস্যদের মোট সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ (নিকটবর্তী পূর্ণসংখ্যা)। তবে জেলা পরিষদে কমপক্ষে দুজন নারী সদস্য থাকতে হবে।
২০১৬ সালে জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপিসহ বিরোধী দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নেননি। কিছু জেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। ভোটে বেশির ভাগ জেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দেশের প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ১৭ এপ্রিল ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল বিলুপ্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না।
৬১ জেলা পরিষদের বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) পৃথক আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এই তিন জেলা পরিষদের প্রথম ও একমাত্র নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এরপর আর নির্বাচন হয়নি। পরে সরকার আইন সংশোধন করে তিন জেলায় তিনজন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মনোনয়ন দিয়ে আসছে। এই তিন জেলার প্রতিটিতে বর্তমানে সরকার মনোনীত একজন চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দায়িত্ব পালন করছে।
অর্ধেকের বয়স ৭০ বছরের বেশি দেশের ৬১টি জেলা পরিষদের প্রশাসকদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬১ জন প্রশাসকের মধ্যে ৩০ জনের বয়স ৭০ বছরের বেশি। ৫০ বছরের কম বয়সী প্রশাসক আছেন দুজন। বাকি ২৯ জনের বয়স ৫০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। বগুড়া জেলা পরিষদের প্রশাসক মকবুল হোসেনের বয়স ৮৮ বছর। তিনি দেশের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক জেলা পরিষদ প্রশাসক। আশি ঊর্ধ্ব বাকি জেলা পরিষদ প্রশাসকেরা হলেন গোপালগঞ্জের চৌধুরী এমদাদুল হক (৮৪), নওগাঁর এ কে এম ফজলে রাব্বি (৮৪), নাটোরের মো. সাজেদুর রহমান খান (৮৩) ও মুন্সিগঞ্জের মো. মহিউদ্দিন (৮১)।
সবচেয়ে বেশি বয়সী জেলা প্রশাসক মকবুল হোসেন দেড় দশক ধরে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে রয়েছি। জেলা পরিষদের চেয়ার পেয়ে ভালো আছি। ভবিষ্যতেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।’
বগুড়া জেলা পরিষদে গত পাঁচ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ এসেছে। বরাদ্দের টাকায় মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, মসজিদ-ঈদগাহ মাঠ, রাস্তাঘাট, ডাকবাংলো সংস্কার করা হয়েছে।
বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন সুলতান মাহমুদ খান। তিনি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। সুলতান মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদ থেকে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসক বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বার্ধক্যজনিত কারণে দাপ্তরিক ও রুটিন কাজটুকু কোনোমতে করতে পারেন। প্রশাসকের প্রকল্প নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করার মতো অবস্থা না থাকায় পরিষদের অনেক উদ্যোগ মাঝপথে থেমে আছে।
নাটোর জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক সাজেদুর রহমান খান ২০১১ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে চেয়েছেন। কিন্তু একবারও প্রার্থী হতে পারেননি। বর্তমানে সাজেদুর রহমানের একা চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তাঁর সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজন সহকারী থাকেন।
সবচেয়ে কম বয়সী জেলা পরিষদের প্রশাসক পঞ্চগড়ের ৪৬ বছর বয়সী আনোয়ার সাদাত। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আনোয়ার সাদাত দায়িত্বে আছেন ২০১৯ সাল থেকে। পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান আমানুল্লাহর মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আনোয়ার সাদাত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আরেক কম বয়সী পিরোজপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক মহিউদ্দিনের বয়স ৪৯ বছর। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
‘বঞ্চনার’ ইতিহাস হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মুশফিক হুসেন চৌধুরী ২০১১ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিন দশক। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। একবারও দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে ২০১০ সালে এ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
মুশফিক হুসেন চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দলের রাজনীতি করছি। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। যোগ্যতা থাকার পরও সবাই সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিকভাবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কারণে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা পুরস্কার হিসেবে জেলা পরিষদের দায়িত্ব দিয়েছেন বলেই আমি মনে করি।’
বরগুনা জেলা পরিষদের প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি। ২০০১ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। কোনোবারই মনোনয়ন পাননি।
বরিশাল জেলা পরিষদের প্রশাসক মইদুল ইসলাম মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ এবং হিজলা) আসনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি।
ফরিদপুরে জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক শামসুল হক। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। এর আগে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তিনিও সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে একাধিকার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে একবারও মনোনয়ন দেয়নি। এই আসনে দুবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
জেলা পরিষদকে আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র করে ফেলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, এভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। জেলা পরিষদকে অকার্যকর ও বিকলাঙ্গ করে রাখা হয়েছে। আর এখন যে প্রক্রিয়াতে জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে, সেটিও সঠিক প্রক্রিয়া নয়। আইন সংশোধন করে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।