‘শয়তানের নিঃশ্বাস’-বাংলাদেশে নয়া আতঙ্ক

বাংলাদেশে নয়া আতঙ্ক ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’
পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা ‘ডেভিলস ব্রেথ’ * অন্যের আদেশ পালনে বাধ্য করানোর মূলমন্ত্র * জাদুটোনার মতোই কাজ করে স্কোপোলামিন
কায়েস আহমেদ সেলিম
বাংলাদেশে নয়া আতঙ্ক ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’
দেশে অভিনব কৌশলে বেড়ে চলেছে নানা প্রতারণা ও ছিনতাই। প্রতারণার নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্র।
বর্তমানে নতুন একটি পন্থা দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ পন্থায় একজন প্রতারক কিংবা ছিনতাইকারী ভুক্তভোগীকে চাইলেই কাবু করে নিজের ইশারায় নাচাতে পারেন।
প্রতারক যে নির্দেশনাই দেবেন, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন সেই নিরীহ ভুক্তভোগী। বিষয়টি জাদুটোনার মতোই কাজ করে।
রাজধানীর মাদারটেক আজিজ স্কুল মহল্লার বাসিন্দা রঞ্জু মনোয়ারা। ১৮ জানুয়ারি অনলাইনে পুরাতন ফ্রিজ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন তিনি।
কেনার কথা বলে আশিক নামের এক ক্রেতা তার বাড়িতে আসেন। ফ্রিজ দেখে মোটামুটি পছন্দ হয় তার। পরদিন তিনি তার স্ত্রী পরিচয়ে এক মহিলাকে নিয়ে আবার ওই বাড়িতে আসেন। তারা রঞ্জু মনোয়ারার ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছিলেন।
এক সময় রঞ্জু মনোয়ারা ওই মহিলার হাতে তুলে দেন তার গলা ও হাতের অলংকার, ঘরে রাখা নগদ টাকাসহ কয়েক ভরি স্বর্ণালংকার। কিছুক্ষণ পর তারা ওই বাসা থেকে বিদায় নেন।
তাদের এগিয়েও দেন রঞ্জু মনোয়ারা। তবে কিছু সময় পর পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসায় এসে সবকিছু এলোমেলো দেখে তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি বেহুঁশ হয়ে যান।
হুঁশ ফেরার পর একে একে তার মনে পড়তে থাকে আগের ঘটে যাওয়া সব দৃশ্য। তবে ততক্ষণে সব শেষ। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ ধরনের ঘটনা এখন রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় প্রায়ই হয়ে থাকে। আর এ অপরাধ সংঘটিত করতে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বা স্কোপোলামিন।
শয়তানের নিঃশ্বাস একটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। রাসায়নিকভাবে এটি স্কোপোলামিন নামে পরিচিত। স্কোপোলামিন একটি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ট্রোপেন অ্যালকালয়েড এবং অ্যান্টিকোলিনার্জিক ড্রাগ।
এটি হায়োসিন, ডেভিলস ব্রেথ, শয়তানের নিঃশ্বাস, বুরুন্ডাঙ্গা, রোবট ড্রাগ, জম্বি ড্রাগ বা কলম্বিয়ান ডেভিলের নিঃশ্বাস নামেও পরিচিত। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে। রোগীকে অপারেশনের আগে অজ্ঞান করতে এটা ব্যবহার করা হয়।
এটি মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দুর্বৃত্তরা লোকজনকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিতে এটি ব্যবহার করে। বর্তমানে এটি মাদক হিসাবে বা হেলুসিনেটিক ড্রাগ হিসাবে খুব ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুণ বেশি। বাংলাদেশের নয়া আতঙ্ক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এ মাদক।
এর প্রভাব এতটাই ভয়ংকর যে, কোনো ব্যক্তিকে সেকেন্ডেই নিজের নিয়ন্ত্রণে অনায়াসেই আনা যায়। ফলে অনেক ব্যবসায়িক এবং করপোরেট সেক্টরেও কর্তাব্যক্তিদের এটি প্রয়োগ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে থাকে প্রতারক চক্র।
অন্যের আদেশ পালন করতে বাধ্য করানোই হলো এ মাদকের মূলমন্ত্র। ভুক্তভোগীরা হেপনোটাইজ হয়ে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান।
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার বেশি পরিলক্ষিত হলেও এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নানাভাবে ও নানা কৌশলে এটি প্রয়োগ করা হয়। যেমন, হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে, ঘ্রাণের মাধ্যমে, খাবারের সঙ্গে, চিরকুটের মাধ্যমে, কোমল পানীয়র সঙ্গে, বাতাসে ফুঁ দিয়ে।
স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই ফরমেটেই পাওয়া যায়। এ ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, যার প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিন দিন।
মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে শয়তানের নিঃশ্বাসের প্রভাব : স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিঃশ্বাস শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের প্রাথমিক স্মৃতি ব্লক হয়ে যায়।
ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে দেখতে পেলেও চিনতে পারেন না এবং কিছু মনে রাখতে পারেন না। এর প্রভাবে শরীরে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না বা বাইরের কোনো আক্রমণে শরীর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর মতো অবস্থায়ও থাকে না।
এ অবস্থায় ভুক্তভোগীর আচরণ হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মতো। তীব্র হেলুসিনেশন শুরু হয়। অন্যের দেওয়া আদেশকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য করে। মানে আপনি নিজে কিছু করতে পারবেন না, শুধু সামনের লোক যা বলবে তাই করবেন রোবটের মতো।
গবেষণায় জানা গেছে, ভয়ংকর এ সংস্পর্শে এলে ভুক্তভোগী নিজ ইচ্ছায় কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই সবকিছু তুলে দেয় প্রতারকের হাতে। সত্য উদঘাটনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও এ মাদকটি ব্যবহার করেন। কলম্বিয়ায় উৎপন্ন হওয়া এ মাদকটি নিয়ে ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি সর্বপ্রথম কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
বর্তমানে এ মাদকটি মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যরা ব্যবহার করে থাকে। কলম্বিয়ায় উৎপত্তি হলেও ইকুয়েডর ও ভেনিজুয়েলাতেও মাদকটির যথেষ্ট বিস্তার রয়েছে। এছাড়া পেরু, আর্জেন্টিনা, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি মাদক হিসাবে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং ওই দেশের অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সি নারীদের দিয়ে নীলছবি ও অবাধ মিলনে বাধ্য করতে এটি ব্যবহার করে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মেজর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বেশকিছু ড্রাগ রয়েছে যেগুলোর প্রয়োগে মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এর মধ্যে অন্যতম স্কোপালামিন বা ডেভিলস ব্রেথ। সংশ্লিষ্টদের এখনই সতর্ক হওয়া ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এছাড়া বায়ুবাহিত অজানা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মাস্ক ব্যবহার করা দরকার।
এর সুবিধা হলো দুষ্কৃতকারীরা সহজে টার্গেট করবে না। টার্গেট করলেও মাস্ক প্রটেকশন দেবে এবং সচেতন হলে ততক্ষণে বুঝে যাবে যে, ভুক্তভোগীর সঙ্গে কী হতে যাচ্ছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *