আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে এসে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীর
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল এবং লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য থাকার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই রেজিমেন্ট ‘তার হৃদয়ের খুব কাছের।’
‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ এর ‘দশম টাইগার্স পুনর্মিলনী’ অনুষ্ঠানে এসে একই সঙ্গে আনন্দ ও বেদনার মিশ্র অনুভূতি হল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
তিনি আনন্দিত ছিলেন এ কারণে যে, বাংলদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা একটি বাহিনীর আনন্দঘন একটি আয়োজনে যোগ দিয়েছেন। আর তাকে বেদনার্ত করেছে নিজের ছোট দুই ভাইয়ের স্মৃতি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের ভয়ঙ্কর সেই রাতে প্রাণ হারানো বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল এবং শেখ জামাল এই রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। পুনর্মিলনীতে এসে শেখ হাসিনার মনে হয়েছে, ছোট ভাইদেরকেও তিনি এই আয়োজনে দেখতে পারতেন।
বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) হয় এই অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি হয়ে যান সরকারপ্রধান।
বাসস জানায়, অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে রেজিমেন্টের একটি চৌকস দল রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। এরপর খোলা জিপে চড়ে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন তিনি। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল এবং লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য থাকার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই রেজিমেন্ট ‘তার হৃদয়ের খুব কাছের।’
“তাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে যোগ দেওয়া একদিকে আমার জন্য বেদনাদায়ক, অন্যদিকে আনন্দের”, এভাবেই নিজের অনুভূতির বর্ণনা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে পুরষ্কৃত করা, ছয় বছর তার প্রবাস জীবন, দেশে ফিরে আসা, ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।
তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালে আমাদের বিজয়ের ইতিহাস কলঙ্কলিপ্ত হয় । জাতির পিতাকে হত্যার পর সমস্ত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেমে যায় এবং আমাদের স্বাধীনতার আদর্শ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।”
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে এসে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীর
‘বহিঃশক্তির আক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম সেনাবাহিনী গড়া হচ্ছে’
রেজিমেন্ট সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। আমরা বঙ্গবন্ধুর ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু বহিঃশক্তির যে কোনো আক্রমণ মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যাপ্ত সক্ষম করে তুলতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।”

বাংলাদেশকে একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ দেশে রূপান্তর করার স্বপ্নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তাই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি।”
মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে জাতির পিতা এদেশকে গড়ে তুলেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সে সময়ই তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেন।
“১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির উদ্বোধন করেন এবং কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল ও সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “তার (বঙ্গবন্ধু) শাসনামলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। তিনি ভারত ও যুগোশ্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধ জাহাজ সংগ্রহ করেন। ১৯৭৩ সালে সে সময়ের অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার বিমান বাহিনীতে যুক্ত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালেই একটি প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করেন।”
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠার এবং নারী মহিলা সৈনিক ভর্তির সিদ্ধান্তের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে সরকারে ফিরে ‘প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন’ যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছে তার সরকার।
“আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এবং ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। অ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছি।”
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে এসে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীর
দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন এবং গত ৪ বছরে ৩টি ব্রিগেড এবং ছোট-বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠার কথাও জানান শেখ হাসিনা। মাওয়া-জাজিরায় ‘শেখ রাসেল সেনানিবাস’ এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আর্মি এভিয়েশনের ফরোয়ার্ড বেস এবং লালমনিরহাটে এভিয়েশন স্কুল নির্মাণের কাজও এগিয়ে নেওয়ার তুলে ধরেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্তকরণ এবং প্রতিটি বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক এবং যুগোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
‘সশস্ত্র বাহিনী শুধু দেশে নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ায় বিদেশেও’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী সবসময় দেশ ও জণগণের পাশে আছে। যে কোনো দুর্যোগে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তাদের পাশে দাঁড়ায়, শুধু দেশে নয় বিদেশেও।
“যখনই বন্ধুপ্রতীম কোন দেশে দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে যায় এবং উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ ও সেবা দিয়ে থাকে। পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী শান্তিরক্ষী বাহিনী গৌরবজনকভাবে দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে যাচ্ছে।”
তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার কাজে সফলভাবে অংশগ্রহণের কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
‘সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা’- এ মূলমন্ত্রে দীক্ষিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গৌরবময় ইতিহাসেরও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের এই রেজিমেন্টের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য সকলকে আমার আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুনর্মিলনীতে এসে আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভূতি প্রধানমন্ত্রীর
গৃহহীণ ও ভূমিহীনকে ঘর করে দেয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্প, ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন এবং দেশের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণেরও প্রশংসা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতি দেশ ও জাতির আস্থার স্বীকৃতি স্বরূপ এ পর্যন্ত ৩৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জাতীয় পতাকা অর্জন করেছে, ২০১৪ সালে আমার হাতে এ প্যারেড গ্রাউন্ডে ৩টি রেজিমেন্টের জাতীয় পতাকা গ্রহণের স্মৃতি আজ মনে পড়ছে।”
রেজিমেন্টের আনন্দ ও উৎসবমুখর পুনর্মিলনী অবসরপ্রাপ্ত ও চাকুরিরত সর্বস্তরের সদস্যদের মাঝে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় করবে বলে আশা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমাদের দেশপ্রেমিক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যগণ জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ অর্পিত সকল দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালনে সক্ষম হবে এবং কর্মজীবনে সকল ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *