লেবুর স্বাস্থ্যগুণ যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি সারা পৃথিবীতে খাবার আর পানীয়তেও এর ব্যবহারের শেষ নেই।
লেমনেড বলি আর লেবুর শরবত, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়ের তালিকার প্রথম স্থানটি লেবু, পানি ও চিনির এই স্বর্গীয় দ্রবণেরই প্রাপ্য। এই গরমে হিমশীতল লেবুর শরবতে যোগ হতে পারে চিনির বদলে আখের গুড়। আবার হেলথ ড্রিংক হিসেবে আদা-মধু পড়তে পারে এতে। লেমন মিন্ট মোহিতোসহ অসংখ্য জনপ্রিয় পানীয়ের মৌলিক উপাদান কিন্তু এই লেবু-পানিই। বিউটি লাচ্ছির লেবুর শরবত ঢাকার গৌরব হয়ে যেমন শতবর্ষ পেরিয়ে গেল, তেমনি চীনের গুয়ানিইন প্যাভিলিয়নের চায়ের দোকানের লেবু-চা সবার মন মাতাচ্ছে ৩০০ বছর ধরে। চায়ে লেবুর রসের ব্যবহার পৃথিবীর সব দেশেই এখন সমান জনপ্রিয়। ফলাফলও দারুণ, সুবাসে আর স্বাদে।
খাবারে লেবুর ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন। সর্বজনীনও বটে। তাজা লেবুর রস ছিটিয়ে আমাদের ডাল-ভাত-মাছ, উত্তর ভারতের বিলাসী সব মাংসের পদ, কন্টিনেন্টাল ফিশ অ্যান্ড চিপস আর ক্র্যাব কেক—এ সবকিছুই পায় এক অন্য মাত্রা। যেকোনো সালাদে লেবুর রস দেয় নতুন প্রাণ। সালাদ ড্রেসিংয়ের মধ্যে ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং লেমন ভিনেগারেটই বোধ হয় সবচেয়ে জনপ্রিয়। অলিভ অয়েল আর লেবুর রসের ইমালশন তৈরি করা হয় এতে। ইমালশনের কথা যখন চলেই এল, লেমন কার্ডের কথা বলতেই হয়। মৃদু আঁচে দ্রুত নাড়তে নাড়তে লেবুর রসের সঙ্গে এই ডিমের কুসুমের ফেটানো মিশ্রণ ঠিক ফুটে ওঠার আগেই নামিয়ে ফেলার নিপুণ কায়দা সবার করায়ত্ত হয় না সহজে। তবে লেমন কার্ডের টার্ট যে খেয়েছে, সে–ই জানে এর মহিমা। প্রায় একই কায়দায় বানানো মাখন-ডিমের কুসুমের মসৃণ হল্যান্ডাইজ সসেও সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ লেবুর রসই মূল নায়ক। এ ছাড়া ইউরোপ–আমেরিকায় আছে বিচিত্র ধরনের সব লেমন কেক।
ইউরোপীয় খাবারে লেবুর রসের পাশাপাশি লেবুর খোসার ঝুরি বা লেমন রাইন্ডও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে মজার ব্যাপার হলো, আমরা পাকা লেবু পছন্দ না করলেও পশ্চিমারা সবুজ লেবুকে লাইম আর হলুদ লেবু লেমন হিসেবে ব্যবহার করে সমানতালে।
লেবুর ব্যবহার বড়ই বিচিত্র দেশ-বিদেশের হেঁশেলে। ওরিয়েন্টাল খাবারে কড়া লেবুর ফ্লেভারে লেমন চিকেন, লেমন-জিনজার ফিশ আর বিভিন্ন স্যুপ তুমুল জনপ্রিয়। দক্ষিণ আমেরিকান লাতিন কুইজিনে তরতাজা কাঁচা মাছ পাতলা স্লাইস করে লেবুর রস মেখে সেই অ্যাসিডিক প্রতিক্রিয়ায় মাছের টেকশচার নরম করে নিয়ে তাতে পেঁয়াজ, মরিচ মেখে দারুণ মজার সেভিচে বানানো হয়। লেমন রাইস যেমন জনপ্রিয়, লেমন গার্লিক পাস্তাও তেমন।
এদিকে আস্ত শুকনা লেবু ছাড়া মরক্কোর রান্নাঘর অচল। এর ব্যবহার রয়েছে মিসর, তিউনিসিয়াসহ আফ্রিকার আরও সব দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে। লেবু শুধু এভাবেই সংরক্ষণ করা হয় না অবশ্য। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই লেবুর পিকেলস বা আচার খুব জনপ্রিয়। অত্যন্ত পুষ্টিমানসম্পন্ন লেবুর খোসার সাদা অংশ ঝুরি করে মুড়িমাখা, হালিম, ঘুগনি ইত্যাদির সঙ্গে খাওয়া হয় পুরান ঢাকায়। নেহারি, হালিমের সঙ্গে লেবুর রস ছিটিয়ে না নিলে স্বাদের কমতি রয়ে যায় কোথাও। লেবু দিয়ে ইলিশ মাছ, খাসির মাংস ইত্যাদির বিশেষ পদ রান্না করা হয়। লেবুপাতাও দারুণ ফ্লেভার দেয় মাছের ব্যঞ্জনে। তাজা মাছের ঝোল বা একটু নরম হয়ে আসা মাছের পুড়পুড়ি—লেবুপাতার জাদুতে তা হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুস্বাদু।
লেবুপাতার জাদুতে : লেবুর আরেকটি বিশেষ গুণ হচ্ছে, দুধের জলীয় অংশ আলাদা করে ফেলতে পারে এর অম্লীয় চরিত্র। ছানা ও পনির তৈরিতে তাই এর ভূমিকা রয়েছে। এখন এই ছানা দিয়ে ডালনা বা ছানাপোড়া হবে, নাকি সন্দেশ, রসগোল্লা, সীতাভোগ আর পায়েস—সে আরেক প্রশ্ন। ইদানীং আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলেছে লেবু দিয়ে বানানো বাংলাদেশি স্ট্রিট ফুড লেবুর পিনিক। চাক চাক করে স্লাইস করা লেবুর ওপরে বেদম ঝাল কাঁচা মরিচ আর মুখরোচক নুন-মসলা ছিটিয়ে বানানো এই ভাইরাল লেবুর পদ দেখলেই জিভে জল চলে আসে।
লেবুর স্বাস্থ্যগুণ যেমন বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি সারা পৃথিবীতে খাবার আর পানীয়তেও এর ব্যবহারের শেষ নেই। তাই লেবু বেশি কচলে তিতা না করে এই বেলা ক্ষান্ত দেওয়াই ভালো।