প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে দেশের উন্নয়ন হয় : প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার প্রতি ভারত কৃতজ্ঞ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল যৌথভাবে তিনটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন -পিআইডি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা আরও নিবিড় হতে চলেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বৃহত্তম অংশীদার। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভারত কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তৈরির স্বপ্নপূরণে ভারত সহযোগী থাকবে।
গতকাল নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকের নিজ অফিস থেকে ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বোতাম টিপে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করে যৌথভাবে ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার আখাউড়া-আগরতলা আন্তসীমান্ত রেলসংযোগের উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন। একই অনুষ্ঠানে দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে ভারতের সহায়তার আরও দুটি উন্নয়ন প্রকল্প খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন এবং মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্লান্টের দ্বিতীয় ইউনিটও উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ড. মানিক সাহা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে বাংলাদেশ সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে দেশের উন্নতি হয়, আমরা সেটাই প্রমাণ করেছি। আমি মনে করি বিশ্বের জন্য এটা একটা দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর যৌথ উদ্বোধন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে অনন্যসাধারণ বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ। বিগত বছরগুলোয় আমরা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি। যার মধ্যে রয়েছে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ সহজীকরণ ছাড়াও অনেক কিছু। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভাষা দ্বারা আবদ্ধ। আমাদের দুই দেশই ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রসহ অগণিত বিষয়ে অভিন্ন মূল্যবোধ পোষণ করে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, সে সময় তাঁর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। এ দুটি খাতে বাংলাদেশের অর্জিত উল্লেখযোগ্য সাফল্যের জন্য তিনি ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো এবং উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশের জনগণ ও তাঁর তরফ থেকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় করতে আপনার আন্তরিকতার জন্যও আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণের জন্য ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। চলচ্চিত্রটি বর্তমানে ভারতসহ বাংলাদেশের সব প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। কলাকুশলীসহ নির্মাণসংশ্লিষ্ট সবাইকেও তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আত্মত্যাগের কথা জানতে পারবে। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) যে তিনটি প্রকল্প আমরা উদ্বোধন করেছি তা উভয় দেশের জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। এ প্রকল্পগুলো আঞ্চলিক যোগাযোগের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্লান্টটি আরও সাশ্রয়ী মূল্যে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিশেষ অবদান রাখবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্যান্য ব্যয়বহুল উৎসের ওপর থেকে আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে নিয়ে আসবে। পাশাপাশি সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আখাউড়া-আগরতলা রেলসংযোগ আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে সংযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধিকরণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। খুলনা-মোংলা বন্দর রেলসংযোগ প্রকল্পটি মোংলা বন্দরকে বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সারাসরি যুক্ত করবে। এতে আমদানিকৃত কনটেইনারগুলো সহজেই রেলের সাহায্যে দেশের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন সম্ভব হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর এবং চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ভারতের জনগণ যাতে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাঁর সরকার উন্মুক্ত করে দিয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, বিগত প্রায় ১৫ বছরে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। দেশে চরম দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালে থাকা ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে তার সরকার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ও লক্ষ্যের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সেজন্যই সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে। গত বছর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। এ সেতু আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থায় বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, রাজধানীতে মেট্রোরেল পরিষেবা চালু, ঢাকায় প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং গেল অক্টোবরে পদ্মা সেতু রেল পরিষেবারও উদ্বোধন করা হয়েছে। মাত্র কদিন আগে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করেছি। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের আরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দুই দেশের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনেক বাস্তব ফল অর্জন করেছি। যার মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ সহজীকরণ প্রভৃতি। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ড. মানিক সাহা বলেন, আখাউড়া-আগরতলা আন্তসীমান্ত রেলসংযোগের মাধ্যমে উভয় দেশের জন্য ইতিহাস তৈরি হলো। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হলো। এ ধারা আগামীতেও বজায় থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরও যা বললেন : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। তিনি এও আশ্বাস দেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলা গড়ার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তাতে ভারত সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। ১২টি জেলায় যে আইটি পার্ক গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাতে ভারত অংশগ্রহণ করবে। মোদি বলেন, আজকের তিনটি প্রকল্প উদ্বোধনের পরে ভারত-বাংলাদেশ যোগাযোগব্যবস্থা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাল। তিনি বলেন, গত নয় বছরে দুই দেশের মধ্যে এত কাজ হয়েছে যে, বিগত কয়েক দশকে তা হয়নি। স্থলসীমান্ত চুক্তি থেকে সমুদ্র চুক্তি দুই দেশের সম্পর্ক বিকশিত করেছে। এত কাজ হয়েছে যে, গোটা দিন লেগে যাবে সব বলতে। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটছে প্রকল্প রূপায়ণে। রেল যোগাযোগের পাশাপাশি ঢাকা-আগরতলা-গুয়াহাটি-শিলং-কলকাতা এখন বাসের মাধ্যমে সংযুক্ত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ থেকে কনটেইনার পার্সেল সার্ভিস চালু হয়েছে। অভ্যন্তরীণ জলপথ চালু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরার রপ্তানি বাণিজ্য বহুগুণ বেড়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে। গঙ্গাবিলাস প্রমোদতরী চালু হওয়ার পর পর্যটনশিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আগরতলা-আখাউড়া দুই দেশের মধ্যে প্রথম রেল যোগাযোগ যা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরার ভূমিকা ঐতিহাসিক ছিল বলে এ রেল যোগাযোগ ঐতিহাসিক। খুলনা-মোংলা রেল যোগাযোগ ভবিষ্যতে ঢাকা-কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করবে। তাতে বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বৃহত্তম অংশীদার। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভারত কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, ত্রিপুরা থেকে আগেই ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি হচ্ছিল। মৈত্রী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ হবে। আগেই ডিজেল পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের এনার্জি নিরাপত্তা সুরক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা আরও নিবিড় হতে চলেছে।