মোহাম্মদপুর, বছিলা, রায়েরবাজার এবং পশ্চিম ধানমন্ডি’র খাল রক্ষায় মানববন্ধন

মো. মনজুরুল ইসলাম (মনজু) : “হাইক্কার খাল, লাউতলা খাল, বছিলা উত্তরপাড়া খাল, বিবির খাল, চন্দ্রিমা খাল, আটিখাল বাঁচাও- বুড়িগঙ্গা বাঁচাও” এই দাবি নিয়ে মোহাম্মদপুর, বছিলা, রায়েরবাজার এবং পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার খালগুলো পুনরুদ্ধারের দাবিতে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), বুড়িগঙ্গা রিভার কিপার, বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চা এবং বছিলা এলাকাবাসীর যৌথ উদ্যোগে আজ ১১ জুন (মঙ্গলবার) সকাল ১১ টায় হাইক্কার খালের মুখে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

ধরা’র সদস্য সচিব এবং বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে এবং ধরা’র সদস্য মামুন কবীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মানবন্ধনে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী, রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রমূখ।

মানববন্ধনে এলাকাবাসীর সাথে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য সংগঠন নিরাপদ চিকিৎসা চাই এর মহাসচিব উম্মে সালমা, বনলতা নারী উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ইসরাত জাহান লতা, আমিনবাজার ঘাট শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি এবং তুরাগ নদী মোর্চার নেতা আমজাদ আলী লাল, বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার এর ভলান্টিয়ার মাহির দাইয়ান প্রমূখ।

এছাড়াও এলাকাবাসীর পক্ষে বক্তব্য রাখেন বছিলা পুরাতন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মানিক হোসেন, জেলেপাড়া মন্দির কমিটির সভাপতি স্বপন রাজবংশী, জেলে নেতা গোপাল রাজবংশী, এবং বুড়িগঙ্গার পাড়ে বসবাসকারী স্থানীয় অধিবাসী তাজুল ইসলাম।

শরীফ জামিল বলেন, নদীর জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে, ছোট নদী, শাখা নদী, উপ নদী, খাল, কাজেই আমরা যদি এগুলো কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি, প্লাবন অঞ্চলকে ভরাট করে ফেলি, খালগুলোকে বেঁচে থাকতে না দেই তাহলে আমাদের বসতি হুমকির মুখে পড়ে যাবে। খালগুলো উদ্ধার না হলে নদী মৃত, হাত পা না থাকলে মানুষ যেমন বেঁচে থাকবে না, তেমনই এই খাল গুলো ছাড়া নদী মৃতপ্রায়। ঢাকার মানুষকে শুধু বিল্ডিং দিয়ে আর রাস্তা দিয়ে বাঁচানো যাবে না, যদি খাবার পানির জোগান না দেয়া যায়।

তিনি আরো বলেন, নদীপাড়ের মানুষের সাথে আলোচনা না করে যে ওয়াকওয়ে তৈরি করা হচ্ছে তাতে নদীপাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা আজ হুমকির সম্মুখীন। ওয়াকওয়ে তৈরির জন্য গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। উন্নয়ন করতে হবে পরিবেশ রক্ষা করে আর নদীর সাথে সম্পর্কিত মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসকারী ওয়াকওয়ে অপসারণ করতে হবে।

মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, কিন্তু বুড়িগঙ্গা পাড়ে এই বহুতল বিল্ডিং ও অবৈধ দখলদারদের বৈধতা দেয়া এই ওয়াকওয়ে শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর মানুষ কে সুখী করে, এবং যেই মানুষগুলো নদীর সাথে বছরের পর বছর বসবাস করে আসছে তাদেরকে অসুখী করেছে এবং নদী কেন্দ্রীক জীবন ও জীবিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা এই মানুষগুলোর জীবনকে আর বেশি দুর্বিষহ করে তুলবে।

ফয়সাল আহমেদ বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে কোনভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং সেই উন্নয়ন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আজ অথবা কাল আমরা সকলেই এর দ্বারা আক্রান্ত হব। অতএব যত দ্রুত আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি হবে যে আমরা প্রাণ প্রকৃতি বিনষ্ট করে আমাদের উন্নয়ন করবো না, তত দ্রুতই আমাদের মঙ্গল হবে।

উম্মে সালমা বলেন, হাইক্কার খাল জায়গাটার নাম এখন কেউ জানে না, জানবে কি করে এখানে তো এখন কোন খাল নেই। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে আমাদেরকে অবশ্যই হাইক্কার খালসহ অন্যান্য খালগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ইসরাত জাহান লতা বলেন, আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষতি করে যাচ্ছি। সরকার এবং যারা খাল দখল করে বাড়ি বানাচ্ছে তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছে। আমরা জেনে শুনে বিপদ্গ্রস্থ হচ্ছি কিন্তু কেউ রুখে দাঁড়াচ্ছি না, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

আমজাদ আলী লাল বলেন, এখানে আগে ৬০০ নৌকা ছিল কিন্তু তা কমতে কমতে আজকে মাত্র ৩ টা নৌকা আছে। যেভাবে বাঁধ দিয়ে আপনারা খাল নদীকে ধ্বংস করছেন, ঠিক একইভাবে একদিন আমরা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাব।

মাহির দাইয়ান বলেন, বর্জ্য ও বেদখলের কারণে প্রতিটা নদীর নাব্যতা এখন ধ্বংসের মুখে। যারা এই খাল বা নদীর উপর নির্ভরশীল তাদের জীবিকা ফিরিয়ে দেয়া এবং অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

মানিক হোসেন বলেন, বাঁচাও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে মোহাম্মদপুরের বছিলার শ্রীখণ্ড মৌজা হয়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কবরস্থানের মধ্য দিয়ে লাউতলা ও রামচন্দ্রপুর খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল হাইক্কার খাল। হাইক্কার খালের এই শাখার নাম হলো বসিলা উত্তরপাড়া খাল। হাইক্কার খালের আরো একটি শাখা খাল হলো বিবির খাল। এছাড়াও চন্দ্রিমা খাল, লাউতলা খাল, আটি খালসহ মোহাম্মদপুর, বছিলা, রায়েরবাজার এবং পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার সকল খাল নানা উন্নয়ন প্রকল্প ও দখলদারদের কবলে পড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং মৃতপ্রায়।

এছাড়াও মানববন্ধনে স্থানীয় এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের খাল নাই, আমাদের মাছও নাই। আমাদের বুড়িগঙ্গা ধ্বংস হচ্ছে আর সেই সাথে ধ্বংস হচ্ছে আমরাদের জীবন-জীবিকা। নদীর পাড়ে যে ওয়াকওয়ে তৈরি হচ্ছে তাতে আমাদের সাথে নদীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের হাসঁ-মুরগী, গবাদি পশু নদীতে পড়লে আর উঠানোর পথ নাই। আমরা সারাদিন আতঙ্কে থাকি আমাদের শিশুরা কখনো পানিতে পড়ে গেলে আমরা আর তুলতে পারবো না।

জেলেপাড়া মন্দির কমিটির সভাপতি অভিযোগ করে বলেন, এখানে আমাদের সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুইশত বছরের পুরাতন মন্দির। আমরা এখানে এই বছিলা ঘাটে দেবীর বিসর্জন দিতাম। আমাদের পূজার দেবীর বিসর্জন দেওয়া জায়গাটাও তারা রাখলো না। আমরা কোথায় যাবো তাহলে?

মানববন্ধন থেকে হাইক্কার খাল, বছিলা উত্তরপাড়া খাল, চন্দ্রিমা খাল, লাউতলা খাল, আটি খালসহ মোহাম্মদপুর, বছিলা, রায়েরবাজার এবং পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার সকল খালসমূহকে পুনরুদ্ধার এবং বুড়িগঙ্গার পাড়ে বসবাসকারী নদীর সাথে সম্পর্কিত মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসকারী ওয়াকওয়ে অপসারণের আহ্বান জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *