জলবায়ু নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনীতি : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকি যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতির গতিশীলতাকে ক্রমশ প্রভাবিত করছে। “জলবায়ু নিরাপত্তা” ধারণাটি জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব এবং কীভাবে তা বৈশ্বিক নিরাপত্তা, সম্পদ সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে জড়িত, সেই সাথে বিভিন্ন দেশ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সে বিষয়টি নির্দেশ করে। জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে এর প্রভাব পুরো পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যা নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে এবং রাজনৈতিক জোট ও শত্রুতার নতুন ধারাও গড়ে তুলছে।

জলবায়ু নিরাপত্তার মূল বিষয় হলো, কীভাবে পরিবেশগত অবনতি ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে তা চিহ্নিত করা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির ক্রমবর্ধমান সংখ্যা অনেক অঞ্চলের বিদ্যমান দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। যেসব দেশ ইতিমধ্যে সংঘাত বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন, তারা বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর প্রতি সংবেদনশীল। জলবায়ু পরিবর্তন যখন খাদ্য ও পানি সংকট, জনসংখ্যা স্থানান্তর এবং অর্থনৈতিক চাপের সাথে যুক্ত হয়, তখন সামাজিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য লড়াইয়ের কারণ হতে পারে।

জলবায়ু নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো সম্পদের অভাব। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে অনেক অঞ্চলে পানি, কৃষিজমি এবং সামুদ্রিক সম্পদের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। এই অভাব প্রতিযোগিতা ও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীলতা রয়েছে। যেমন, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল বা মধ্যপ্রাচ্যের মতো এলাকায় পানি সংকট দিন দিন গুরুতর হয়ে উঠছে, যা স্থানীয় জনগণ ও সরকারগুলোর জন্য সম্পদ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সহিংসতা, সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান বা সীমান্তবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত দেখা দিতে পারে।

জলবায়ু নিরাপত্তা এবং ভূরাজনীতি অত্যন্ত জটিল আন্তঃসংযুক্ত বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা, শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা শান্তি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত নীতিগত উদ্ভাবন প্রয়োজন, একইসাথে জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন ভূরাজনৈতিক কৌশলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে দেশগুলো ক্রমশই বুঝতে পারছে যে জলবায়ু পরিবর্তন গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে, ফলে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে জলবায়ু নিরাপত্তার বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে। এর ফলে জলবায়ু কূটনীতিতে নতুন করে আগ্রহ দেখা দিচ্ছে, যেখানে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নতুন জোট গঠন করছে। উদাহরণস্বরূপ, আর্কটিক অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায় সেখানে নতুন সম্পদ ও বাণিজ্যিক পথ উন্মুক্ত হয়েছে, যার ফলে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং কানাডার মতো দেশগুলো প্রভাব বিস্তার এবং নতুন সুযোগের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলো সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন এবং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সমর্থনের জন্য শক্তিশালী মিত্র খুঁজছে। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়েছে, কারণ বড় শক্তিগুলো এই জলবায়ু-সংকটাপন্ন দেশগুলিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা জলবায়ু নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে। অনেক এলাকা যখন পরিবেশগতভাবে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে, তখন সেখানকার জনগণ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়। এই ধরনের স্থানান্তর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয়ভাবে হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের স্থানান্তর নতুন সামাজিক উত্তেজনা এবং সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যেমন, আফ্রিকা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খরা-প্রবণ অঞ্চল থেকে জনসংখ্যার স্থানান্তর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে, যার ফলে রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভাজন আরও গভীর হয়েছে।

অন্যদিকে, অভিবাসন সংকট মোকাবিলার জন্য সরকারগুলোর ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও দেখা দিচ্ছে। অনেক উন্নত দেশ, বিশেষত ইউরোপ, জলবায়ু-সংকট ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসীদের ঢেউ মোকাবিলায় রাজনৈতিক চাপ ও প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ধরনের অভিবাসন চলতে থাকলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন হবে, তা কেবল সময়ই বলে দেবে।

বিশ্বের জ্বালানি প্রেক্ষাপটেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ যখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে আসছে, তখন বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। কয়েক দশক ধরে, তেল এবং গ্যাসের উপর নিয়ন্ত্রণ বিশ্বশক্তির প্রধান উৎস ছিল। কিন্তু, নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এই প্রবণতা সেই শক্তিকে নতুনভাবে বিতরণ করছে। নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী দেশগুলো, যেমন চীন ও জার্মানি, বিশ্বব্যাপী নতুন প্রভাব ও নেতৃত্বের স্থান দখল করছে, যা আগামী দিনের ভূ-রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়াও, নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ যেমন লিথিয়াম, কোবাল্ট, এবং দুর্লভ মাটি সম্পদের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতা বেড়েছে। চীন এবং চিলির মতো দেশগুলো এই সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে জ্বালানির জন্য পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো নতুন আকারে দেখা দিচ্ছে।

জলবায়ু নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনীতির মধ্যে সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি, এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই সংলাপ এবং সহযোগিতার পথ তৈরি করেছে। প্যারিস চুক্তির মতো উদ্যোগগুলো বিশ্বকে একত্রিত করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রায়ই এই সহযোগিতাকে জটিল করে তোলে। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার এবং জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলো ধীরগতিতে অগ্রসর হতে পারে।

উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে টানাপড়েন চলছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা দাবি করে। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চাপ এবং কার্বন নির্গমন কমানোর প্রয়োজনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার বিশ্বের অন্যতম দেশ। এর ভৌগোলিক অবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা একে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সহ্য করতে বাধাগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের জলবায়ু নিরাপত্তা শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক সমস্যা নয়; এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। দেশের এক তৃতীয়াংশ নিম্নাঞ্চলে অবস্থান করায় এবং তিনটি বৃহৎ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এ ধরনের বিপর্যয় মানুষের জীবিকা, বসতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করছে, যার ফলে জনগণ ক্রমশ নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু নিরাপত্তার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো জলবায়ু-জনিত অভিবাসন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির ফলে শহরগুলোতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ এবং পরিবেশগত অবনতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূমিহীনতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও গভীর করতে পারে।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যেসব দেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতিতে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দাবি করে আসছে। প্যারিস চুক্তির আলোচনায় বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক উদ্যোগকে সমর্থন করছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর কাছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জলবায়ু নিরাপত্তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি কৌশলগত অঞ্চলে অবস্থান করার কারণে, বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং তা আঞ্চলিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও বিবেচিত হচ্ছে। ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে নদীভাঙন এবং পানি সংকটের কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় টানাপোড়েন বাড়ছে।

এছাড়া, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনও জলবায়ু সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে, কারণ এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীও বাংলাদেশের পরিবেশ এবং সমাজে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে পানির উপর ভিত্তি করে নতুন ধরণের সংঘাত ও উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে।

বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের কৃষি খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তা প্রভাবিত হচ্ছে। নদীভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, যা দেশের প্রধান খাদ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খাদ্য ঘাটতির ফলে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খাদ্য আমদানির উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং জলবায়ু অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, কারণ তারা প্রাথমিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হলেও এর জন্য দায়ী নয়। কিন্তু জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় এটি একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ এই বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরেছে, এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব কৌশলও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশে বেশ কিছু পুনর্বাসন ও অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যার মধ্যে বন্যা প্রতিরোধ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, এবং কৃষি খাতে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য। এসব কর্মসূচি দেশের জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটগুলো কিছুটা হলেও মোকাবিলায় সহায়ক হচ্ছে।

জলবায়ু নিরাপত্তার প্রসঙ্গে বাংলাদেশে একটি জটিল চিত্র দেখা যায়। একদিকে দেশের নিজস্ব সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক শক্তির ভূ-রাজনৈতিক চাহিদার মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যমূলক ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, জলবায়ু অর্থায়ন, এবং দেশের নিজস্ব জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতার ওপর।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বিক জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জলবায়ু নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনীতি অত্যন্ত জটিল ও আন্তঃসংযুক্ত বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা, শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত ও নীতিগত উদ্ভাবন প্রয়োজন, একইসাথে জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

[ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *