কী খাচ্ছি দারুচিনি নাকি সিনামন

…সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।…

‘সুচেতনা’, জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে দারুচিনি দ্বীপের কথা, তার রহস্যময় শ্যামলিমার কথা, সেই সবুজের গহিনে দিকহারা নাবিকের আশ্রয়-আকাঙ্ক্ষার কথা। এই দারুচিনি দ্বীপ কি আসলে কোনো সমুদ্রঘেরা ভূখণ্ড, নাকি বনলতা সেন নিজেই, তা নিয়ে কবিরা বিতর্ক করুক। আমরা বরং এই দ্বীপের তত্ত্বতালাশ করি।

দারুচিনি দ্বীপের কথা শুনলেই আপনার মনে কোন দেশের কথা মনে হয়? নির্ঘাত শ্রীলঙ্কা। কিন্তু কেন? আমরা যে মিষ্টি কিন্তু ঝাঁজালো মসলা ব্যবহার করি প্রায় প্রতিদিন, সেই দারুচিনি কি শ্রীলঙ্কা বা সিংহল থেকে আসে? যদি বলি ‘না’, তাহলে খানিক ধাক্কা লাগবে।

দুনিয়ায় দারুচিনি দুই ধরনের। একটা দেখতে গাছের বাকলের মতো, এর ঘ্রাণ আর ঝাঁজালো মিষ্টি স্বাদে প্রাণ ভরে যায়। এটি আমাদের মায়েরা প্রতিদিন ব্যবহার করছেন, হোটেল-রেস্তোরাঁ আর বিয়েবাড়ির খাবারে সুবাস ছোটাচ্ছে। এটি আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি, যার কেতাবি নাম ক্যাসিয়া।

অন্য ধরনের দারুচিনি অনেকটাই আলাদা। গাছের পাতলা বাকল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হাভানা চুরুটের মতো পাকিয়ে লম্বা লাঠির মতো বানিয়ে ইঞ্চি কয়েক করে কেটে সুদৃশ্য কাচের বোতলে বন্দী করে বিক্রি হয় ইউরোপের দোকানে। সেই বস্তুর নাম সিনামন। গন্ধে ও স্বাদে আমাদের দারুচিনির মতো হলেও তীব্রতায় অনেক ম্রিয়মাণ। অথচ তার দাম ক্যাসিয়ার চেয়ে বেশি। তাই সিনামন একধরনের দারুচিনি হলেও আমাদের ‘সাথে তার হয় নাকো দেখা’!

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমাদের অতিপরিচিত দারুচিনি শ্রীলঙ্কায় জন্মায় না! এর আদিনিবাস দক্ষিণ-পূর্ব চীনে। পরে কালের পরিক্রমায় মালয় সাগর বা ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপে বিস্তার লাভ করে। শ্রীলঙ্কায় জন্মে অতিমূল্যবান সিনামন, যা আমাদের দারুচিনি থেকে রূপে-গুণে-ঘ্রাণে আলাদা।

দক্ষিণ চীন থেকে আরব আর পারস্যের বণিকেরা জাহাজে করে যে বস্তু মালয় সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের উপকূলের নগর-বন্দরে-বাজারে বিক্রি করে অবশিষ্টাংশ ইউরোপে পাঠাতেন আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে রোমে অথবা ভেনিসে, তাই-ই আমাদের পরিচিত দারুচিনি। আর সেই বণিকদের আরেক অংশ সিংহল দ্বীপ থেকে অথবা মালাবার বন্দর থেকে অনেক মূল্য দিয়ে আঁটি বেঁধে নিয়ে যেতেন সিনামন। শুনতে অনেকটা ধাঁধার মতো লাগে।

আসলে দারুচিনি নামের ভেতরেই এ ধাঁধার উত্তর আছে।

‘দারুচিনি’ ফারসি শব্দ, যা ভাঙলে হয় দার-এ-চিনি অর্থাৎ ‘চীন দেশের বাকল’। আশা করি, এখন ব্যাপারটি পরিষ্কার।

খুব সম্ভবত কবি জীবনানন্দ দাশ নিজেও এই কাহিনি জানতেন। তাই দারুচিনি দ্বীপের অবস্থান তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতায় রহস্যাবৃত রেখেছেন এই বলে, তা সিংহল সাগরেও হতে পারে, হতে পারে মালয় সাগরে। হয়তো এই দুই সাগরে সব দ্বীপই দারুচিনি দ্বীপ।

তা ক্যাসিয়াই হোক আর সিনামন, এই পুরু বা পাতলা বাকল আসলে একই গোত্রের গাছ থেকে আসে। এদের মিষ্টি ঘ্রাণ আর স্বাদ মানবসভ্যতাকে বিমোহিত করে রেখেছে হাজার হাজার বছর ধরে। মিসরের ফারাও বা ফেরাউনরা তাদের যজ্ঞ, দেবতার তুষ্টি, উৎসব বা শোকে দারুচিনি পুড়িয়ে অর্ঘ্য দিত। এমনকি মমিতেও দেওয়া হতো দারুচিনির গুঁড়া। প্রাচীন প্যাপিরাস পুঁথিতে সুদূর কোনো দেশ থেকে যাওয়া দারুচিনির কথা বলা আছে। বাদশা সোলায়মানের দরবারে শিবার রানি দেখা করতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বড় ধরনের এক বস্তা দারুচিনি। তাতে ধনকুবের বাদশা সোলায়মানের আক্কেলগুড়ুম হয়েছিল সম্ভবত।

সেই সময় দারুচিনি ছিল অতিমূল্যবান বিলাসদ্রব্য। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের কয়েক জায়গায় দারুচিনির উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এশিয়ার সুদূরতম প্রান্তের বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপের কথা বিন্দুমাত্র না জানলেও পুরো মধ্যপ্রাচ্য, মিসর এবং ইউরোপ দারুচিনির প্রেমে দিওয়ানা ছিল, যেকোনো মূল্যেই তা পাওয়া নিশ্চিত করতে তারা পিছপা হতো না।

এই দারুচিনিসহ অন্যান্য লোভনীয় মসলা ইউরোপে পৌঁছাত মূলত আরব বণিকদের হাত ঘুরে। তাঁরা একাধারে ছিলেন বণিক এবং মধ্যস্বত্বভোগী। তাঁরা কোনোভাবেই জানতে দিতে চাইতেন না, এই দারুচিনি দ্বীপের উৎস কোথায়। তাই বিভিন্ন রকম গালগল্প তাঁদের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিম দুনিয়ায়। এই দারুচিনিসহ অন্যান্য মসলার জন্যই শ্রীলঙ্কায় অভিযান চালিয়েছিল চীন, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ আর ইংরেজরা। সে এক রক্তাক্ত ইতিহাসের গল্প।

সেই গল্প থাক; বরং ভাবতে থাকুন, কী খাচ্ছি—দারুচিনি নাকি সিনামন।

[ড. তৈফুর রহমান]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *