দেশে বর্তমানে ডিভোর্স বা বিয়েবিচ্ছেদের হার বেড়েছে: কেমন আছেন ঢাকার একক মায়েরা

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশে বর্তমানে ডিভোর্স বা বিয়েবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। অন্তত পরিসংখ্যান সেই কথাই বলছে। এর সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত পাচ্ছে একটি টার্ম- সিঙ্গেল মাদার বা একক মা। সন্তান হওয়ার পর ডিভোর্স হলে বেশিরভাগ সন্তান তাদের মায়ের সঙ্গেই থাকছে। ফলে নিজের পাশাপাশি সন্তানকে বড় করে তোলার সংগ্রামের ভেতর দিয়েই চলছে একক মায়েদের জীবন।
ঢাকায় বসবাসরত এমনই কয়েকজন একক মায়ের জীবনের গল্প জানা গেল তাদের মুখে। তামান্না তিথি (ছদ্মনাম)। ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় থাকেন ৩২ বয়সী এই নারী। তিথি বলেন, “কোনো মেয়েই শখ করে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তে যায় না। আমাদের সমাজে একটা মেয়ের একা থাকাটাই মানুষ বাঁকা চোখে দেখে। আমি ডিভোর্সের পর মানুষ চিনেছি খুব ভালোভাবে।”
তিনি বলেন, “আপনজনরা দূরে সরে গেছে; নিজের পরিবারও পাশে নেই। তবুও সন্তানকে একটা টক্সিক (বিষাক্ত) সম্পর্কের ভেতর রাখার চেয়ে, স্লো পয়জন গ্রহণ করার মতো ধীরে ধীরে মরে যাওয়ার চেয়ে একবারে কষ্টকে স্বীকার করা ভালো। যেটা ঘটে গেছে, সেটা মেনে নিয়ে চলছি। একা ছেলেকে নিয়ে কষ্ট হয়, তবে মানসিকভাবে শান্তিতে আছি- এটাই অনেক।”
এই নারী মনে করেন, “জীবনে সংগ্রাম থাকবেই, উত্থান-পতনও থাকবে। কিন্তু একটা মেয়ে যদি স্বাবলম্বী হয়, তবে তার সঙ্গে কেউ না থাকলেও জীবন অতটা কঠিন হয় না। পায়ের নিচে মাটি থাকা খুব জরুরি।”
রেহনুমা দিশা (ছদ্মনাম) থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। সাড়ে ৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকেন তিনি। দিশা বলেন, “আমরা (স্বামী-স্ত্রী) একসঙ্গেই ছিলাম, তবে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেছি (সম্পর্ক) ঠিক করার, কিন্তু কোনোভাবেই অ্যাডজাস্টমেন্ট (সমন্বয়) হচ্ছিল না। আমাদের মধ্যে কখনও মারাত্মক ঝগড়া হয়নি, কিন্তু সবকিছুতে ছিল মতের অমিল। যেটা নিয়ে মনোমালিন্য ছিল, শ্বশুড়বাড়ির মানসিক অত্যাচারও ছিল।”
তিনি বলেন, “সব মিলিয়ে আর পারছিলাম না। তবে আমার একটা সুবিধা- বাচ্চাকে আমার মা-বাবার কাছে রেখে অফিসে যেতে পারি। কিন্তু সেখানেও অনেকের কটু কথা শুনতে হয়। প্রতিবাদ তো সবাই করতে পারে না, আর করে লাভও নেই। তাই নিজের মতো ভালো থাকার চেষ্টা করি। বাচ্চার জন্য চাকরিটা ধরে রেখার চেষ্টা করি।”
তিনি বলেন, “মা-বাবার ওপর আর্থিকভাবে এখন আর নির্ভর করা সম্ভব নয়। এমনিতেই মেয়েকে নিয়ে তাদের কাছে থাকি।”
একেকজন একক মায়ের সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন হলেও শব্দটা একই- “সিঙ্গেল মাদার”।
“সিঙ্গেল মাদার” টার্মটি বাকি সবার মতো একই হলেও ৩৫ বছর বয়সী এশা করিমের (ছদ্মনাম) জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন। ৫ বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন বনশ্রীর একটি বাসায়। পেশাগত কারণে বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকতে হয়।
তার কথায়, “অনেক দিন ধরে সেপারেশনে (আলাদা) ছিলাম। তখন আমার মেয়েকে দেখার জন্য আরেকটা কিশোরী মেয়েকে রেখেছিলাম। আমি অফিসের কাজে বাইরে থাকলেও ওর কাছে আমার মেয়ে খুব ভালো থাকত। কিন্তু ওই মেয়েটি চলে যায় একসময়। পরে দ্বিগুণ পারিশ্রমিকে নতুন (কাজের) লোক ঠিক করলেও মেয়ে তার সঙ্গে থাকতে সাচ্ছ্বন্দ্যবোধ করে না।” ফলে নতুন করে বিড়ম্বনায় পড়েছেন এই নারী।
তিনি বলেন, “(মেয়ে) প্রচুর কান্নাকাটি করে। একান্ত বাধ্য হয়ে তাকে তার বাবার কাছে আপাতত রেখেছি। সুযোগ পেলেই দেখে আসি বা ছুটির দিনে আমার কাছে নিয়ে আসি। মাত্রই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। কিছু সময় অফিসের কাজের ফাঁকে স্কুলে গিয়ে দেখে আসি।”
এখন বাবার সঙ্গে থাকলেও তিন-চার মাস পর সেখানে রাখার আর উপায় থাকবে না। এই ভাবনায় এখন থেকেই দুশ্চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে চলছেন তিনি।
“তখন মেয়েকে কীভাবে রাখব সেটা ভেবে অস্থির লাগে। এদিকে মেয়েকে সপ্তাহের কয়টা দিন দূরে রাখতেও প্রতি মুহুর্তে হাহাকার লাগে। মেয়েকে ভিডিও কল দিলেই বলে- মা, আমাকে তোমার কাছে একেবারে নিয়ে যাও। এটা একটা মায়ের জন্য যে কতটা কষ্টের, তা যারা এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, তারা বুঝতে পারবেন। এই কষ্ট আমি অনুভব করি প্রতিনিয়ত। তবু ওর জন্য বাঁচতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, স্বাবলম্বী হয়ে নিজের এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।”
সাজিয়া সাবরিনা (ছদ্মনাম), বয়স ৩৬। সন্তান নিয়ে মা-বাবা, ভাই-ভাবির সংসারে থাকেন মোহাম্মদপুরে। স্বামীর প্রতারণা সামনে আসার পর হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। চাকরি করেন না, কিন্তু মেনেও নিতে পারেন না। ৪ বছরের মেয়ে ও ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়ি।
তিনি বলেন, “আমি সুশিক্ষিত, কিন্তু ভালো পরিবারে বিয়ে হওয়ায় চাকরিটা করা হয়ে ওঠেনি। নিজেরই তেমন ইচ্ছে ছিল না। আর এই বয়সে চাকরি পাওয়াও কঠিন। দুইটা সন্তানসহ মা-বাবার কাছে বোঝা না হলেও ভাই-ভাবির কাছে যে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা নেই—সেটা বুঝি। সেলাইয়ের কাজ শিখে সেই আয় সংসারে দেই, পাশাপাশি সন্তানদের পড়াই।”
তার কথায়, “আত্মসম্মান বাঁচিয়ে ওখান থেকে চলে এসেছি। কিন্তু এখানে কষ্ট করে পড়ে আছি শুধু সন্তানদের কথা ভেবে। এখন বুঝি জীবনের পরিস্থিতি যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে। তাই স্বামীর যা কিছু থাকুক, একটা মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া খুব জরুরি।”
“মেয়ের জন্য ভেবেছিলাম কম্প্রোমাইজ করে থেকে যাই সম্পর্কের টানাপোড়েনের এই সংসারে। কিন্তু যখন দেখি, আমাকে কথার মাধ্যমে নির্যাতন করা দেখে মেয়ে ট্রমাটাইজড (মানসিক চাপে ভোগা) হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই সম্পর্কে থাকার চেয়ে বেরিয়ে আসা সম্মানজনক মনে করেছি। একটা সম্মানজনক পেশায় থাকার পরও অনেককেই এমন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছি।”
তবে দুজন মানুষ আলাদাভাবে ভালো মানুষ হলেও তাদের মতের অমিল হওয়া, অ্যাডজাস্টমেন্ট না হওয়া স্বাভাবিক বলে স্বীকার করে নেন এই নারী। এমন ক্ষেত্রে সন্তানের ভালোর জন্য বিচ্ছেদের পরও কেউ কারও প্রতি অভিযোগ না করে একটা সুস্থ সম্পর্ক রাখা যায় বলে মনে করেন তিনি।
আরও বলেন, “আমি কখনোই বিচ্ছেদের পক্ষে না, তবে সম্পর্কে সাবলীল না হলে সেটা কারও জন্যই ভালো কিছু নিয়ে আসে না। সেক্ষেত্রে বেরিয়ে আসাই ভালো। বিচ্ছেদ সবসময় যে নেগেটিভ তা নয়, কিছু সময় মানসিক শান্তি ও আত্মসম্মান রক্ষা করতে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
“অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তবে সমাজ আগের চেয়ে বদলেছে। আগে ডিভোর্স হলে মেয়েদের শুধু কটুবাক্যই শুনতে হতো। এখন পজিটিভলি সাপোর্ট দেয় সহকর্মী, বন্ধুসহ অনেকেই।”
যা বলছে।

পরিসংখ্যান: দেশে ডিভোর্সের হার নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে স্থূলবিচ্ছেদের হার ০.৬% থেকে ১.১%-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস–২০২২ নামের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে তা বেড়ে ১.৪%-এ দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞের মত: বিয়েবিচ্ছেদের কারণ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, “মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক এবং উদার মানসিকতার পরিচয় বহন করছে। ডিভোর্সকে শুধু একটা তকমা দিয়েই কারও জীবনকে বিচার করা উচিৎ নয়। সবাই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।”

আগের তুলনায় মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াও বিচ্ছেদের একটা বড় কারণ বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তার মতে, পরনির্ভরশীলতা মানুষের মনকে দুর্বল করে। শুধু স্বনির্ভর না হওয়ার কারণে অনেকে অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলে।তিনি বলেন, “তবে ডিভোর্সের আগে সন্তান থাকলে এখনও তাকে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান বলা হয়। মানুষ যেমন জীবনের তাগিদে একসঙ্গে থাকে, তেমনি জীবনের প্রয়োজনেই আলাদা হয়। কাজেই এই বিষয়গুলো সন্তানের মনে যেন বিরূপ প্রভাব না ফেলে, তার জন্য ছোট থেকেই তাদের মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। সন্তান যার কাছেই থাকুক, মা-বাবাকে বোঝাতে হবে— তুমি একা নও। যেটা ঘটে গেছে সেটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা।”
এক্ষেত্রে এই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সন্তানদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। মা-বাবার আলাদা থাকা যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় এবং হতেই পারে- সেটা সন্তানকে বোঝাতে হবে।
প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আধুনিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে বলে জানান তিনি।
সর্বোপরি, বড় ধরনের কোনো সমস্যা না থাকলে বিচ্ছেদ কাম্য নয়। একে-অপরের মতের, চিন্তার ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে পারলে বিয়েবিচ্ছেদের মতো বিষয় অনেকাংশেই এড়ানো যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *