সাপ্তাহিক জনতার কণ্ঠ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ সেবা পেতে ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় নির্বাচন করার বিষয়ে ইতিবাচক অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
সম্প্রতি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এক জনমত জরিপে উঠে এসেছে, ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সুপারিশও করেছে। তবে আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ আছে।
জামায়াতে ইসলামী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে। বিপরীতে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল চায় আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গতকাল শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাতেও কোনো কোনো দল বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে।
আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিও। বৈঠক শেষে দলটির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা স্থানীয় নির্বাচন আগে চাই না। কারণ, স্থানীয় নির্বাচন দিলে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মারামারি হওয়ার আশঙ্কা আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।’
গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। এরপর মূলত বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য ইসিকে পরামর্শ দেয় জামায়াতে ইসলামী। এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দিনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে।
অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কাউন্সিলর, পৌর কাউন্সিলর পদগুলোয় জনপ্রতিনিধি নেই। জনগণের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেককেই দুটি করে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ফলে মন্ত্রণালয়ের কাজের অ্যাফিশিয়েন্সি (কার্যক্ষমতা) কমে গেছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা নেই, স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কেও তাঁরা অবগত নন। এতে জনসেবামূলক ও দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত হলেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারকে জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অবশ্য এ নির্বাচনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে অনুরোধ জানালে সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের কাজ শুরু করে ইসি। এমন কোনো অনুরোধ ইসি এখনো পায়নি।
ইসি এখন পর্যন্ত ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ইসি জানিয়েছে, সরকার চাইলে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে। সারা দেশে ধাপে ধাপে সব কটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন করতে হলে এক বছরের মতো সময় লাগবে বলে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ইসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গত ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করে। সেখানে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে মতামত উঠে আসে। বিষয়টি তখন প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছিল। মূলত দুটি বিষয় মাথায় রেখে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা ভাবা হচ্ছে।
প্রথমত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের অনেক জনপ্রতিনিধিও আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে বেশির ভাগ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন নির্বাচন কমিশনের একটি পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা হবে। সরকারও সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। নির্বাচনী যেসব সংস্কার আনা হবে, সেগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটাও এর মাধ্যমে বোঝা সম্ভব হবে।