
শত বছর কে না বাঁচতে চায়! কিন্তু সে আশা খুব কম মানুষেরই পূরণ হয়। স্থানকাল ভেদে মানুষের আয়ুর পার্থক্য দেখা যায়। কোনো দেশে মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছর, আবার কোনো দেশের ৮০। তবে গড় আয়ুকে টেক্কা দিয়ে কিছু মানুষের বয়স ১০০ ছাড়িয়ে যায়। ১১০ বছর বা তারও বেশি সময় বেঁচে থাকার রেকর্ডও আছে। যদিও তেমন মানুষের সংখ্যা বেশ কম, তবুও এর পেছনের রহস্য জানতে আগ্রহের মানুষের শেষ নেই। এটা কি কেবলই কাকতালীয়, না কি এর পেছনে কোনো গোপন রহস্য আছে!
মারিয়া ব্র্যান্যাস মোরেরা ছিলেন সেই অল্প কিছু মানুষের মধ্যে একজন। ১১৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। বিজ্ঞানীরা তাঁর বয়সের রহস্য জানতে গবেষণা শুরু করেছেন।
মারিয়া ১৯০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর পরিবারসহ স্পেনে চলে যায়। বাকি জীবন সেখানেই কাটান। ২০২৪ সালে ১১৭ বছর বয়সে মারা তিনি মারা যান। বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নেন মারিয়া। গবেষকরা তাঁর রক্ত, ইউরিন, মল ও লালা পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষা থেকে তাঁরা এমন কিছু পার্থক্য পেয়েছেন যা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলে না। সেগুলো একটু জেনে নিই।
১. বিশেষ ধরনের জিন বা জেনেটিক ভ্যারিয়েন্টস
মারিয়ার শরীরের জিন ৭৫ জন স্প্যানিশ নারীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। এতে সাতটি বিরল জিনের ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এর আগে ইউরোপের মানুষের শরীরে এমন জিন দেখা যায়নি। এই জিনগুলো মারিয়ার শরীরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছে। যেমন, মস্তিষ্কের কাজ চালু রাখা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, ফুসফুস ও হৃদ্যন্ত্রের স্বাভাবিক স্পন্দন বজায় রাখা এবং ক্যানসারের মতো রোগ প্রতিরোধ করা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিরল জিনগুলোই মারিয়াকে দীর্ঘকাল সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মাইট্রোকন্ড্রিয়া আমাদের শরীরের পাওয়ার হাউজ বা শক্তিঘর। কোষের এই অংশ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় শক্তি পাই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কোষের কার্যকারিতা কমে যায়। মাইটোকন্ড্রিয়াও তরুণ বয়সের মতো শক্তির জোগান দিতে পারে না। গবেষকরা মারিয়ার শরীরের মাইট্রোকন্ড্রিয়া পরীক্ষা করে অবাক হন। তাঁর মাইটোকন্ড্রিয়া কেবল ভালোভাবে কাজই করছে না, কম বয়সী নারীদের চেয়েও ভালো কাজ করছে। তার মানে, মারিয়ার শরীরের কোষগুলো বৃদ্ধ বয়সেও সতেজ ও কর্মক্ষম ছিল।
৩. ভালো কোলেস্টেরল লেভেল
মানবদেহে দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। একটা ভালো, অন্যটা ক্ষতিকর। ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে শরীর থাকে রোগমুক্ত। খারাপ কোলেস্টেরল বেশি হলে হৃদরোগের মতো রোগ দেখা দেয়। অনেক সময় মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। মারিয়ার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও ছিল চমৎকার। তাঁর শরীর নিজ থেকেই কোলেস্টেরলের একটা ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। সেই স্বাস্থ্যকর ভারসাম্যই হয়তো তাঁকে হৃদ্রোগ থেকে রক্ষা করেছে।

৪. অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া
শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে বলেই আমরা সুস্থ থাকি। অধিকাংশ রোগ শরীর নিজেই সারিয়ে তোলে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের কারণেই বেশিরভাগ রোগ হয়। কিন্তু মানবদেহেও ভালো কিছু ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। সেগুলো খারাপ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে। এদের উপকারী ব্যাকটেরিয়াও বলা হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো দেহকে রোগ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। মানুষের অন্ত্রে এসব ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশি থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু মারিয়ার অন্ত্রে ঠিক উল্টোটা দেখা যায়। অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে তাঁর অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ছিল বেশি। বিশেষ করে বিফিডোব্যাকটেরিয়াম নামের ব্যাকটেরিয়া। এগুলো শরীরের প্রদাহ কমায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
বিজ্ঞানীরা মারিয়ার খাদ্যাভ্যাসেও পার্থক্য দেখেছেন। মারিয়া প্রতিদিন দই খেতেন। দই প্রোবায়োটিক, মানে উপকারী ব্যাকটেরিয়াসমৃদ্ধ খাবার। দইয়ের মতো খাবারে প্রচুর ভালো ব্যাকটেরিয়া থাকে।
বিজ্ঞানীরা কীভাবে মারিয়ার বয়স নিশ্চিত হলেন?
সুপারসেন্টেনারিয়ান (যাদের বয়স ১১২ বছর বা তার বেশি) মানুষের বয়স নির্ণয় করা কঠিন। অনেকেই জন্মনিবন্ধনের তথ্য দেখাতে পারেন না। ফলে ধারণার ওপর নিজের বয়স দাবি করেন। আবার বেশির ভাগ দেশেই জন্মনিবন্ধন ব্যবস্থা ভালো নয়। এতে বয়সের হিসেব সংরক্ষিত থাকে না। কেউ কেউ ট্যাক্স বা পেনশনের মতো রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতেও নিজের বয়স বাড়িয়ে বলেন। এমনই একটি জনপ্রিয় বিতর্ক আছে। ফ্রান্সের জিন কালমেন্ট নিজের বয়স ১২২ বছর দাবি করেন। কিন্তু গবেষরা দেখলেন, আসলে কালমেন্টের বয়স মাত্র ৫৯। তাহলে মারিয়ার বয়সের বিষয়টাও কি এমন ধোঁকা? না, কিছু পরীক্ষা ও তথ্যে মারিয়া টিকে গেছেন। তাঁর বয়স নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। বিজ্ঞানীরা বয়স মাপার জন্য দুটো বায়োলজিক্যাল মার্কার বা নির্দেশক ব্যবহার করেন।
ক. টেলোমিয়ার: ক্রোমোজোমের শেষপ্রান্তে থাকা এক ধরনের ক্যাপ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি ছোট হতে থাকে। মারিয়ার টেলোমিয়ার প্রায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল। এতে তাঁর প্রকৃত বয়সের সত্যতা প্রমাণিত হয়। টেলোমিয়ারের সময়ের এই ছন্দটাকে বলা হয় মলিকিউলার ক্লক। ক্রোমোজোমের প্রান্তে থাকা ক্যাপের মতো কাঠামোই এজন্য দায়ী।
খ. ডিএনএ মিথাইলেশন ক্লক: এই ঘড়ি কোষের বয়স বলে দেয়। ঠিক কতটা বুড়ো হলো কোষ, তা বুঝতে পারে। আমাদের শরীরের কোষগুলো একটা চক্রে চলে। নির্দিষ্ট সময় পর পর নতুন কোষ গঠিত হয়। মূলত রাসায়নিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই এই পরিবর্তনগুলো ঘটে। অবাক করার বিষয় হলো, মারিয়ার ডিএনএ মিথাইলেশন বয়স ছিল কাগজের হিসেব থেকে ১০-১৭ বছর কম। অর্থাৎ, ডিএনএ ক্লক অনুযায়ী তাঁর বয়স ১০০ থেকে ১১০। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, তাঁর শরীরের বয়স বাড়ার গতি কিছুটা কম ছিল।
এই গবেষণা সামনের দিনে ‘বয়স বাড়ানোর উপায়’ হিসেবে কাজ করতে পারে। দেখা যাবে বিজ্ঞানীরা বয়স প্রতিরোধী ওষুধই বের করে ফেলেছেন।
মারিয়ার দীর্ঘজীবনের রহস্য অনুসন্ধান করে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু ছোট ছোট নিয়ামক পেয়েছেন। যেমন, শরীরে কেবল ভালো জিন থাকলেই হবে না, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণা সামনের দিনে ‘বয়স বাড়ানোর উপায়’ হিসেবে কাজ করতে পারে। দেখা যাবে বিজ্ঞানীরা বয়স প্রতিরোধী ওষুধই বের করে ফেলেছেন। কিংবা প্রোবায়োটিক থেরাপি শুরু হচ্ছে। এই থেরাপিতে অন্ত্রের দেখভাল নিশ্চিত করবে। এছাড়াও মাইটোকন্ড্রিয়ার সতেজতা বজায় রাখার উপায় বের করতে পারলে তো কথাই নেই।
তারপরেও একটা কিন্তু থেকে যায়। মারিয়ার দীর্ঘজীবন ছিল জিন, খাদ্যাভ্যাস, সুন্দর জীবন ব্যবস্থার সম্মিলিত ফল। বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন যে মারিয়াকে নিয়ে করা গবেষণার ফল অন্যদের ক্ষেত্রেও একই হবে কি না। কারণ, একেক মানুষের শারীরিক গঠন একেক রকম। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও সবার এক নয়। অবশ্য একটা বিষয় স্পষ্ট, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা আয়ু বাড়াতে কিছুটা হলেও সাহায্য করে।