ব্যবসায়ীদের কেউ বললেন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকে বিল পেতে দেরি হয়। কেউ জানালেন, দরপত্রের কাজের অনুমোদন (নোট অব অ্যাপ্রুভাল) পেতে বিলম্ব ঘটে। আবার কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন, পণ্য সংগ্রহে টিসিবি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিপিএম) বদলে উন্মুক্ত দর পদ্ধতিতে (ওটিএম) গেলেই পারে। এক ব্যবসায়ী প্রশ্ন তুললেন, টিসিবি নিজেই কেন সরাসরি পণ্য আমদানি করছে না?
আজ বুধবার সরকারি সংস্থা টিসিবি আয়োজিত এক সংলাপে ব্যবসায়ীরা এ কথাগুলো বলেন। ঢাকার আর্মি গলফ ক্লাবের গলফ গার্ডেনে ‘টিসিবির সঙ্গে ব্যবসা’ শীর্ষক এ সংলাপে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রধান অতিথি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী ও টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এতে ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা, চট্টগ্রাম চেম্বারের যুগ্ম সচিব নুরুল আবছার চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ নোমান প্রমুখ বক্তব্য দেন। সংলাপে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও টিসিবির কর্মকর্তাই ছিলেন বেশি। সংখ্যায় এরপরই বেশি ছিলেন সাংবাদিকেরা। ব্যবসায়ীরা ছিলেন সবচেয়ে কম; যাঁরা ছিলেন তাঁদের সবাই অবশ্য কথা বলেননি। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর কাউকে দেখা যায়নি।
প্রবন্ধগুলোয় বলা হয়, দেশের ৬৪ জেলায় টিসিবির মোট ৮ হাজার ৫০০ ডিলার আছে। টিসিবি বছরে ছয় হাজার টন পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সিন্ডিকেট রোধ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। সংস্থাটি প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা; প্রতি কেজি চিনি ৭০ টাকা, মসুর ডাল ৬০ টাকা, ছোলা ৬০ টাকা ও পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সুবিধাবঞ্চিত কোটি পরিবারের পাশে দাঁড়াতে টিসিবির কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সামগ্রিক প্রচেষ্টার কারণে গত রমজানে বাজার ব্যবস্থা ভালো ছিল। একটি দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থা যা অনেক দুর্বৃত্ত তৈরি করেছিল। সেখান থেকে বাজারের যে উত্তরণ, তার জন্য অনেক দপ্তর কাজ করেছে। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা ও আস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার কর্মকালে টিসিবিকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে চাই।’
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘টিসিবি বছরে ১২ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য ক্রয় করে। এ পণ্য বিক্রিতে ৬ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। আমরা এ টাকার উপযুক্ত ব্যবহার দেখতে চাই, যোগ্য উপকারভোগী নির্বাচন করতে চাই এবং এ টাকায় অধিক পণ্য কিনতে চাই। আর সে কারণেই টিসিবির কাজের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ দেখতে চাই।’
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, আগস্ট বিপ্লবের আগে দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে রেহাই পায়নি টিসিবি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত পরিদর্শন করে তিনি এ প্রমাণ পেয়েছেন। এক কোটি পরিবারের জন্য ছিল ফ্যামিলি কার্ড। অথচ এ তালিকা করায় ব্যাপক অনিয়ম করা হয়। সে অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রায় ৪০ লাখ কার্ডধারী কমানো হয়েছে।
প্রয়োজনীয় পণ্য সরাসরি আমদানি করা হবে। এ জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর ফ্যামিলি কার্ডধারী অনেকের পরিচয় নিয়ে যে জটিলতা আছে, তা জুনের মধ্যে নিরসনের জন্য কাজ চলছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দুর্বৃত্তায়নের যে প্রতিচ্ছবি দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে, মানুষের মনে সরকারি ব্যবস্থাপনা বা মাঠ প্রশাসনের ওপর আস্থা কখনোই আসবে না, যদি মানুষ দেখে যে সবকিছুতে দুর্বৃত্তায়ন আছে। এ দুর্বৃত্তায়ন সামাজিকভাবে ও সামগ্রিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। দুর্বৃত্তায়ন থেকে বের করে টিসিবিকে আমরা সঠিক পর্যায়ে আনতে চাই।’
পাটকলের মালিক, পাঁচতলা বাড়ি আছে এবং প্রশাসনে কর্মরত লোকেদের বাড়িতেও টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পাওয়া গেছে বলে জানান শেখ বশিরউদ্দীন।
ভর্তুকি মূল্যে ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদির পাশাপাশি টিসিবির কার্ডধারী পরিবারকে ভবিষ্যতে সাবানও দেওয়া হবে বলে জানান সংস্থাটির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সল আজাদ। তিনি বলেন, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী টিসিবির পণ্য বিক্রির জন্য নতুন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হবে। ডিলার হতে ইচ্ছুক নতুন ও পুরোনো আবেদনকারীদের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে।
আগামী ১ জুলাই নতুন ডিলারের মাধ্যমে কাজ শুরু করা হবে জানিয়ে টিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, প্রয়োজনীয় পণ্য সরাসরি আমদানি করা হবে। এ জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর ফ্যামিলি কার্ডধারী অনেকের পরিচয় নিয়ে যে জটিলতা আছে, তা জুনের মধ্যে নিরসনের জন্য কাজ চলছে।
টিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, পণ্য ওটিএমে (উন্মুক্ত দর পদ্ধতি) কেনাই বেশি ভালো। এতে দর নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। প্রয়োজনে ডিপিএমে (সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি) কেনার বিষয়েও নির্দেশনা আছে। তিনি বলেন, দর প্রস্তাব অনুমোদনে সময় বেশি লাগার কথাটি ঠিক। তবে আগের চেয়ে কম সময় লাগছে। আরও কমানোর সুযোগ আছে।
বিল বিতরণে দেরি হয়, ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ প্রসঙ্গে টিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি কখনো মনে হয়, ইচ্ছা করে বিল দিতে দেরি হচ্ছে, তাহলে আমাকে ও পরিচালকদের জানাবেন।’
সরাসরি পণ্য আমদানি করা হয় জানিয়ে টিসিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখন কম হয়। আমরা চাই, যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁরাই তা করবেন। এ ব্যাপারে টিসিবির পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসা হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, লাভের জন্য নয়, টিসিবি কাজ করছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য।