আজ চিন্তক ও লেখক আহমদ ছফার জন্মদিন। এই দিনে ফিরে দেখা যাক তার অনন্য সাহিত্যবোধ ও চিন্তার জগৎকে, যা এখনো পাঠকসমাজের চিন্তায় রেখাপাত করে যায়।
বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন লেখক নিজস্বতার সুর, দৃষ্টিভঙ্গি ও তীব্র সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন আহমদ ছফা তাদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যের প্রচলিত ধারাকে ভেঙে তিনি যে বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস ও স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন তা আজও বিস্ময় জাগায়। তুলে এনেছেন দেশ, সমাজ ও বাঙালি জাতিসত্তার আলাদা পরিচয়।
১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এই লেখক শুধু সাহিত্যের কারিগর ছিলেন না, ছিলেন এক অসাধারণ চিন্তক, সমাজ-দার্শনিক। আজ তার ৮২তম জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই অনন্য সাহিত্যবোধ ও চিন্তার জগৎকে, যা এখনো পাঠকসমাজের চিন্তায় রেখাপাত করে যায়।
গুণী এই লেখকের ৩০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে সেগুলো নয় খণ্ডে আহমদ ছফা রচনাবলি নামেই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যকর্মে অগ্রণী ভূমিকা রেখেই তিনি ২০০১ সালে ইন্তেকাল করেন। বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য কাজ ও সেই অবদানের স্বীকৃতি মেলে ২০০২ সালে (মরণোত্তর) একুশে পদকের মাধ্যমে।
দুই: আহমদ ছফা ছিলেন বাঙালি সমাজ চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। যে সময় দেশে আরো আরো লেখকের ভিড়ে তিনি আলাদা বৈশিষ্ট্য ও কথাশিল্পী হিসেবে হাজির হয়েছেন। যার প্রত্যেকটা উপন্যাস ও প্রবন্ধে ভাষার পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ইতিহাসে বিচরণের পরিচয়।
এসবের মাঝেই তিনি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন স্বতন্ত্র লেখক হিসেবে। অথচ, এই আহমদ ছফার মতো সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীদের মুখে, লেখকদের মুখে তার স্মরণ নেই। যেমনটা আলোচনা নেই দেশের মিডিয়া পাড়ায়।
আহমদ ছফার সাহিত্যধারা মূলত গ্রামীণ সমাজ, কৃষক শ্রেণি, জাতিসত্তা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে। ‘গাভী বৃত্তান্ত’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’, ‘অলাতচক্র’ এই উপন্যাসগুলোতে তিনি মানুষের মনস্তত্ত্ব, সমাজের অন্তর্লীন অসুখ এবং সময়ের রাজনৈতিক টানাপড়েন তুলে ধরেছেন আপন ভাষায়।
যেখানে অনেকে সাহিত্যকে মধ্যবিত্ত বিলাসিতা আর নাগরিক চেতনার ঘেরাটোপে বন্দি করেছেন, সেখানে ছফা তুলে এনেছেন গ্রামের সরল মানুষের জীবন, সংকট ও সংস্কৃতি। তার লেখার বড় শক্তি ছিল তিনি লোকজ ও বাঙালির জীবনবোধকে পাঠকের সামনে তার আসল রূপে হাজির করতে পেরেছেন।
তিন: বাঙালি কৃষক শ্রেণির লেখক আহমদ ছফা তার লেখায় তুলে এনেছেন বাঙালি কৃষক শ্রেণির কথা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার কথা। এটা কৃষক শ্রেণির বলা হলেও আদতে বাঙালি সংস্কৃতির কথাই ঘুরেফিরে এসেছে তার লেখায়।
এখানেই লেখকের আলাদা কারিশমা। যেখানে অন্যান্য লেখকরা গল্প, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধে শহরে জীবন, উচ্চ বিলাসিতা অথবা সমাজকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন সেখানে একমাত্র আহমদ ছফাই তাঁর লেখায় বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পাঠকের কাছে স্বরূপে হাজির করেছেন।
আহমদ ছফার সবচেয়ে আলোচিত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’। এ প্রবন্ধে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন মুসলমান সমাজের মনস্তত্ত্ব, ইতিহাসচেতনার অভাব, আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব এবং সাংস্কৃতিক সংকট।
তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে রাজনৈতিক ইতিহাস ও ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির ছায়ায় বাঙালি মুসলমানের মন গড়ে উঠেছে আত্মবিশ্বাসহীন, দ্বিধাগ্রস্ত এক কাঠামোয়। তার ভাষায়, ‘মুসলমানদের মন গঠন হয়নি ইতিহাসের ভিত্তিতে, বরং গঠিত হয়েছে ভয় আর অন্ধ অনুসরণের ভিতর দিয়ে।’
চার: আহমদ ছফা কেবল গল্প বলেননি, তিনি চিন্তা জাগিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধ ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ তিনি তীব্র ভাষায় আঘাত করেছেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উপর। এই শ্রেণির আত্মসন্তুষ্টি, সুবিধাবাদিতা এবং নৈতিক শূন্যতাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন একেবারে মূল থেকে।
আহমদ ছফা সম্পর্কে গবেষক সুদীপ্ত হান্নান বলেছেন, ‘আহমদ ছফা প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও লেখেননি।’ এই যে ছফা সম্পর্কে এমন মূল্যায়নই বলে দেয়, ছফা শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি এক নৈতিক দায়ে উজ্জীবিত চিন্তার খোরাক জুগিয়ে গেছেন পাঠকদের মনে।
পাঁচ: লেখক আহমদ ছফার অনন্য সৃষ্টি হলো গাভী বিত্তান্ত, যদ্যপি আমার গুরু, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ ও অলাতচক্র এসব বইয়ের আলোচনায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রকৃতি প্রেম, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সমাজ ভাবনা কোনোটাই বাদ দেননি।
বলেছেন ব্রিটিশ ভারতের নানান পটপরিবর্তনের কথা, শাসক দ্বারা শোষিত মানুষের কথা। এসব কথা তার লেখায় আলাদা আলাদাভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। এই যে তিনি সমাজের নানান রোগ ধরতে পেরেছেন তার অনেকগুলো ব্যাপার আছে এর একটা কারণ হলো তিনি বাঙালি সমাজকে বুঝতেন।
রাজনৈতিক হালচাল আর বাঙালি বুদ্ধিজীবী সাজা মানুষের কুমতলব বুঝতে পারতেন। সেজন্যই দেশ ও দশের কি হাল অবস্থা তার একটা চিত্র তাঁর গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধে দাঁড় করাতে পেরেছেন, সব মহলের পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আহমদ ছফার মতো প্রজ্ঞাবান লেখক আজও মূলধারার পাঠকচর্চায় উপেক্ষিত। তিনি অনেকের কাছেই অপরিচিত, এমনকি অনেক লেখকের মুখেও তার নাম শোনা যায় না। যেই কথাটা ড. সলিমুল্লাহ খান তার নানান টকশো কিংবা আলাপে তুলে এনেছেন।
সলিমুল্লাহ খানের নানান কথা ও লেখায় এর বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সাধারণত এটা এই কারণেই যে, একজন লেখক বা সমাজ চিন্তক হিসেবে আহমদ ছফা যেভাবে সমাজ ও দেশ নিয়ে, বাঙালি কৃষক শ্রেণি নিয়ে ভেবেছেন তার সেই ভাবনাটা সমাজের মানুষের মাঝে দেখা যায়নি।
মূলধারার মিডিয়া, প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চা কিংবা বুদ্ধিজীবী মহল তাকে প্রায়ই এড়িয়ে গেছে। এই উপেক্ষা শুধু একজন লেখককে নয়, বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। ফলে তিনি নানাভাবে অনাবিষ্কৃত থেকে যাচ্ছেন পাঠক সমাজের কাছে।
ছয়: প্রসঙ্গত এখানে এর বাইরে আরেকটা কারণ উল্লেখ করি, দেশে যে ধরনের বুদ্ধিজীবী নামে ‘একটা শ্রেণি’ তৈরি হয়েছে তারা কখনো আহমদ ছফাকে বাঙালি বলেন আর পাঠক শ্রেণি বলেন কারো কাছে উপস্থাপন করেননি।এসমস্ত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী লোকেদের হাতে কলম উঠলে আহমদ ছফার মতো অন্য আরো লেখকরা লোক দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাবেন। আহমদ ছফা সম্পর্কে গবেষক সুদীপ্ত হান্নানের কথা তো বলেছি। তো, আমরা এখনো আহমদ ছফাকে সেভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। এই না পারার ব্যর্থতা মূলত আমাদের।
আহমদ ছফার সাহিত্যচিন্তা ও সমাজ ভাবনাকে ফিরিয়ে আনা দরকার আমাদের পাঠচর্চায়, আলোচনায় এবং গবেষণায়। তার সাহসী চিন্তা, স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাংস্কৃতিক লড়াই এ সময়ে পাঠ করা জরুরি। আমরা যদি তাকে না-জানি, না-পড়ি, তাহলে শুধু একজন লেখককেই নয়, একটি নৈতিক সাহসের সাহিত্যদর্শনকে দিনের পর দিন হারিয়ে ফেলব। নিজেদের শেখড়কে ভুলে যাব।
বলা যায়, আহমদ ছফার সাহিত্য মানে শুধু বই পড়া নয়, একটি মননের ভেতরে প্রবেশ করা, সমাজের গভীর সত্তাকে বোঝার চেষ্টা। তাকে জানার মানে নিজের বাঙালিত্বকে, ইতিহাসকে এবং সংস্কৃতিকে নতুন চোখে দেখা। তাহলে আহমদ ছফাকে ভালোবাসেন আর ভক্তি-শ্রদ্ধা যাই বলেন এসবকিছু সার্থক হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে একজন আহমদ ছফাকে, একজন নৈতিক ও সৎ সাহসের সমাজ চিন্তককে আলাদা করে পৌঁছানো যাবে বলে মনে করি।